সনাতন ধর্ম বা হিন্দুধর্ম বিশ্বজুড়ে এমন একটি প্রাচীন ধর্ম, যা তার ঐতিহ্য, দর্শন, এবং নৈতিক শিক্ষা দিয়ে মানুষের জীবনকে আলোকিত করেছে। সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি হলো সত্য, ন্যায় এবং ধর্মের প্রতি গভীর আস্থা। রাজনীতি, যা সমাজের শাসন এবং পরিচালনা সম্পর্কিত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেখানে এই নৈতিক শিক্ষা কতটা কার্যকরী হতে পারে? আমরা যখন রাজনীতিতে সত্য এবং ন্যায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন সনাতন ধর্মের শিক্ষা আমাদের কিভাবে পথপ্রদর্শন করতে পারে, তা গভীরভাবে ভাবার বিষয়।
সত্যের প্রতি অবিচল বিশ্বাস
“সত্যমेव জয়তে” — এই প্রবাদটি আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। এর অর্থ হলো, সত্যই একমাত্র জয়ী হয়। সনাতন ধর্মে সত্যের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধান করতে হবে এবং যেখানেই তা থাকুক, তাকে গ্রহণ করতে হবে। রাজনীতি বা শাসন ব্যবস্থায় সত্যের গুরুত্ব কি অপরিসীম? নিশ্চয়ই। সত্যই একমাত্র শক্তি, যা মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারে। যখন রাজনীতিবিদরা জনগণের সামনে মিথ্যা বলেন বা তথ্য গোপন রাখেন, তখন তা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায়, একমাত্র সত্যের পথে চললে ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ই সঠিক পথে চলতে পারে।
তবে সত্যের পথে চলা খুব সহজ নয়। অনেক সময় এই পথকে বাধা দেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ, ক্ষমতার লোভ, কিংবা নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য মিথ্যাচার। কিন্তু সনাতন ধর্ম আমাদের বোঝায়, যতই কঠিন হোক না কেন, সত্যের পথ ত্যাগ করা উচিত নয়। মহাভারতের একটি উদাহরণ থেকে এটি স্পষ্ট হয়।
মহাভারতে যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হয়, পাণ্ডবরা সব কিছু হারিয়ে দেন, কিন্তু তারা কখনও সত্যকে ত্যাগ করেননি। পক্ষান্তরে, কৌরবরা সত্যকে অস্বীকার করে তাদের নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল। শেষপর্যন্ত, সত্যের জয় হয় এবং পাণ্ডবরা বিজয়ী হয়। এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত যে, রাজনীতি বা শাসন ব্যবস্থায় সত্যের প্রতি অবিচল থাকলে কখনও না কখনও তার জয় হয়।
ন্যায়ের অনুসরণ
সনাতন ধর্মের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হলো ন্যায়ের পথে চলা। “धर्मो रक्षति रक्षितः” — অর্থাৎ, যিনি ধর্মের অনুসরণ করেন, তিনিই ধর্মকে রক্ষা করেন। রাজনীতিতে ন্যায়ের গুরুত্বও তেমনই অপরিসীম। একজন শাসক বা নেতা যদি ন্যায়পরায়ণ না হয়, তাহলে সমাজে অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সঠিক শাসকই সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখে এবং মানুষের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করে।
রামায়ণের রামের চরিত্রের মধ্যে ন্যায়ের এক উজ্জ্বল উদাহরণ পাওয়া যায়। তিনি যখন আযোধ্যার রাজা হন, তখন তিনি সবসময় ন্যায়ের পথে চলেছেন। রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে সব মানুষকে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছিল। তিনি কোনও ধরনের অবিচারের শিকার হননি এবং সবসময় ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি যখন তার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে সংকট তৈরি হয়েছিল, তখনও তিনি ন্যায়ের পথে হেঁটেছেন।
যতই কঠিন পরিস্থিতি আসুক, সঠিক নীতি অনুসরণ করলেই তা সমাজে শান্তি এবং সঠিক দিশা দেয়।
সদাচরণ ও সততার গুরুত্ব
সনাতন ধর্ম শুধু সত্য এবং ন্যায়ের কথা বলে না, এটি আমাদের সদাচরণের এবং সততারও শিক্ষা দেয়। “सत्यमेव जयते” অর্থাৎ, “সত্যই জয়ী হবে” এই দর্শন আমাদের যে কোন কাজ করতে সততা এবং সদাচরণ অনুসরণ করতে শেখায়। রাজনীতির ক্ষেত্রে সততার অভাব মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং সমাজে অবিশ্বাসের সৃষ্টি করে। একটি সততার ভিত্তিতে তৈরি রাজনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে।
একটি উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে মহাত্মা গান্ধীর জীবন থেকে। তিনি রাজনীতিতে সত্য, ন্যায় এবং সদাচরণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন ছিল নির্দিষ্টভাবে শান্তিপূর্ণ, কিন্তু তিনি কখনোই কখনও মিথ্যা বা অবিচারের আশ্রয় নেননি। এই ধরনের সততার মধ্যে একটা শক্তি রয়েছে, যা মানুষের আস্থা এবং সম্মান অর্জন করে।
রাজনীতিতে সততার প্রভাব সবার জন্য পরিস্কার। যখন একটি জাতির নেতা সততার পথে চলে, তার সিদ্ধান্তগুলো শুধুমাত্র রাজনীতির জন্য নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে।
ধর্মের অনুসরণ এবং মানবিকতা
সনাতন ধর্মের আরেকটি মূল শিক্ষা হলো, ধর্মের প্রতি একাগ্রতা এবং মানবিক মূল্যবোধ অনুসরণ করা। “धर्मो धर्मेण पालयेत्” — অর্থাৎ, ধর্মই ধর্মকে রক্ষা করে। রাজনীতি যদি মানুষের মঙ্গল, শান্তি এবং সুখের দিকে পরিচালিত না হয়, তবে তা কখনওই সত্যিকারের রাজনীতি হতে পারে না। সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায় যে, শাসক বা রাজনৈতিক নেতা শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য শাসন করবে না, বরং তার মূল উদ্দেশ্য হবে মানুষের মঙ্গল।
গীতার এক বিশেষ শিক্ষা, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “कर्मण्येवाधिकारस्ते मा फलेषु कदाचन” (আপনি শুধু কাজের ওপরই অধিকারী, ফলের প্রতি আপনার অধিকার নেই) — এই ধারণা রাজনীতিতে মানবিকতা এবং সেবার গুরুত্বকে ফুটিয়ে তোলে। রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য আমাদের প্রথমত আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং তার পরিণতি কী হবে তা সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
উপসংহার
সনাতন ধর্মের শিক্ষা আমাদের শেখায়, রাজনীতির মূল ভিত্তি হওয়া উচিত সত্য, ন্যায় এবং মানবিকতা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যদি আমরা এই নৈতিকতা অনুসরণ করি, তবে তা সমাজকে শুধু উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, বরং আমাদের জীবনকেও সার্থক ও সুন্দর করে তুলবে। আজকের যুগে, যখন অনেক কিছুই অস্থির, তখন সনাতন ধর্মের এই শিক্ষা আমাদের জন্য একটি আলোকিত পথ দেখিয়ে যেতে পারে।
আমরা যদি সঠিক পথে চলতে চাই, তবে সত্য ও ন্যায়ের সঙ্গে একতাবদ্ধভাবে রাজনীতি করতে হবে। সবার কল্যাণ এবং শান্তির জন্য কি আমরা প্রস্তুত?