আমরা যারা সনাতন ধর্মের পথ অনুসরণ করি, তাদের জন্য একটি বড় প্রশ্ন হতে পারে, “আমাদের ধর্ম কি ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সমর্থন করে?” আপনি যদি গভীরভাবে সনাতন ধর্মের শাস্ত্র এবং দর্শনের দিকে তাকান, তবে দেখবেন যে ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল একটি ধারণা নয়, এটি সনাতন ধর্মের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য।
ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সনাতন ধর্মের দৃষ্টিতে
ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে আমরা সাধারণত বুঝি সব ধর্মের প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন এবং কারো বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ না করা। সনাতন ধর্মে “বসুধৈব কুটুম্বকম” (“সারা বিশ্ব একটি পরিবার”) এই মূলমন্ত্রটি ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি স্থাপন করে। গীতা, উপনিষদ এবং অন্যান্য শাস্ত্র বারবার আমাদের শেখায়, সমস্ত সত্তা একই ব্রহ্মের অংশ।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“সমং সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্।” — (ভগবদ্গীতা ১৩.২৭)
“আমি সব জীবের মধ্যে একইভাবে বিরাজমান।”
এই উক্তিটি ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে সমর্থন করে, কারণ এটি আমাদের শেখায় যে প্রতিটি জীব একই ঈশ্বরের প্রকাশ।
সনাতন ধর্মের ধর্মনিরপেক্ষতা
- মহাভারতের যুগে ধর্মনিরপেক্ষতার উদাহরণ
যুদ্ধের সময়ও, মহাভারতে দেখা যায় শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে ধর্মীয় আদর্শ মেনে চলা হয়েছে। কর্ণ এবং অর্জুনের যুদ্ধের সময় শত্রুতা থাকলেও পারস্পরিক সম্মান অটুট ছিল। এটি আমাদের শিক্ষা দেয়, বিভিন্ন মতাদর্শ থাকা সত্ত্বেও, একে অপরের প্রতি সম্মান দেখানোই ধর্মনিরপেক্ষতার মূল। - উপনিষদের শিক্ষা উপনিষদে বলা হয়েছে:
“একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি” — (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৬)
“সত্য এক, কিন্তু ঋষিরা তাকে বিভিন্ন নামে ডাকে।”
এই বাণীটি আপনাকে মনে করিয়ে দেয় যে, সনাতন ধর্মে একাধিক বিশ্বাসের সহাবস্থান স্বীকৃত।
রামায়ণের উদাহরণ রামচন্দ্র রাবণকে পরাজিত করার পরেও তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং তাকে জ্ঞানী ব্রাহ্মণ হিসেবে সম্মান জানান। এটি দেখায় যে সনাতন ধর্ম ব্যক্তি বা সম্প্রদায় নয়, বরং ধর্মীয় গুণাবলির প্রতি গুরুত্ব দেয়।
আপনার জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতার বাস্তব প্রয়োগ
আপনি যখন বিভিন্ন ধর্ম বা মতাদর্শের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেন, তখন তাদের প্রতি সমান সম্মান দেখানো সনাতন ধর্মের শিক্ষা। উদাহরণস্বরূপ, কোনো বন্ধুর ঈদের আমন্ত্রণে যাওয়া বা কারও ক্রিসমাস উদযাপনে অংশগ্রহণ করা, এগুলো সনাতন ধর্মের ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা।
প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি
গীতার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণী:
“বিদ্যা বিনয় সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি। শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ।” — (ভগবদ্গীতা ৫.১৮)
“বিদ্যা ও বিনয়ের দ্বারা পণ্ডিত ব্যক্তি সকলকে সমানভাবে দেখে।”
এই সমদর্শিতা ধর্মনিরপেক্ষতার মূল শিক্ষা।