রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার সম্পর্কে সনাতন ধর্ম কী বলে?

আমরা প্রায়শই লক্ষ্য করি, রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার সমাজকে বিভক্ত করে। কিন্তু সনাতন ধর্ম আমাদের কী শিক্ষা দেয়? আমি যখন সনাতন ধর্মের গভীরে ডুব দিই, তখন উপলব্ধি করি যে ধর্ম মানবতার সেবায় নিবেদিত হওয়ার জন্য, কোনো বিভাজন বা অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নয়। এই পোস্টে আমরা আলোচনা করব রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার এবং সনাতন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি।

 সনাতন ধর্মের মৌলিক শিক্ষা

সনাতন ধর্মের মূল বক্তব্য হল, “ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ।” অর্থাৎ, যদি আমরা ধর্মের নীতি অনুযায়ী চলি, তবে ধর্ম আমাদের রক্ষা করবে। ভগবদ্গীতায় (২.৪৭) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” এর অর্থ, আমাদের দায়িত্ব সৎভাবে কাজ করা, ফলের প্রত্যাশা করা নয়। রাজনীতিতে যদি এই মূলমন্ত্র গ্রহণ করা হয়, তবে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

 রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহারের উদাহরণ

  •  ধর্মের নামে বিভাজন: প্রাচীন কাল থেকে কিছু শাসক ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন মানুষকে বিভক্ত করতে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ শাসনামলে “বিভাজন ও শাসন” নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল। সনাতন ধর্ম বলে, “একং সত্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি।” অর্থাৎ, সত্য একটাই, কিন্তু তা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়। এই মন্ত্র আমাদের শিখায় যে সব ধর্ম একই মূল সত্যের দিকে পরিচালিত করে।
  •  রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের ব্যবহার: আধুনিক যুগে প্রায়শই দেখা যায়, রাজনীতিবিদরা ভোট পাওয়ার জন্য ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগান। কিন্তু গীতা (১৬.২৩) স্পষ্টভাবে বলে, “যঃ শাস্ত্রবিধিম্ উৎস্য যথা ইচ্ছতি।” অর্থাৎ, যারা শাস্ত্রের বিধি অমান্য করে নিজের ইচ্ছা মতো কাজ করে, তারা কখনো সঠিক পথ খুঁজে পায় না।
  •  ধর্মীয় পরিচয়ের অপব্যবহার: কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীকে অন্যদের থেকে বড় বা ছোট করে দেখানো হয়। এটি সনাতন ধর্মের মৌলিক নীতির বিরোধী। উপনিষদে বলা হয়েছে, “বসুধৈব কুটুম্বকম্।” পৃথিবীর সব মানুষ একটি পরিবার।

 ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য

সনাতন ধর্মে ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য মানবকল্যাণ। “লোকসংগ্রহার্থং”—সমাজের জন্য কাজ করাই ধর্মের আসল লক্ষ্য। রাজনীতিতে যদি এই মন্ত্র অনুসরণ করা হয়, তবে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

  • ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: ধর্ম মানে স্রেফ আচার-অনুষ্ঠান নয়; এটি ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করে। মানু স্মৃতিতে (৭.৯৬) বলা হয়েছে, “যে রাজা ন্যায়ের পথে চলে, তার রাজত্বে সর্বদা সুখ ও শান্তি বিরাজ করে।”
  •  সামাজিক ঐক্যের বার্তা: সনাতন ধর্ম সব সময় ঐক্যের কথা বলে। “সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ“—সবাই যেন সুখী হয়। রাজনীতিতে এই বার্তা গ্রহণ করলে বিভাজনের পরিবর্তে ঐক্যের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

 ধর্ম এবং রাজনীতির বিভাজন কেন প্রয়োজন

রাজনীতি সমাজের সেবার জন্য, আর ধর্ম মানবিক গুণাবলিকে বিকশিত করার জন্য। কিন্তু যখন এই দুইয়ের মিশ্রণ ঘটে, তখন প্রায়ই অপব্যবহার দেখা যায়।

 সনাতন ধর্মের নির্দেশনা:

  • নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি: যজুর্বেদে বলা হয়েছে, “যত্র বিশ্বং ভবত্যেক নীড়ম্।” পৃথিবী যেন একটি পরিবারের মতো হয়। রাজনীতিতে যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়, তবে বৈষম্য দূর করা সম্ভব।
  •  সৎ কার্যকলাপের শিক্ষা: “ধর্ম সৎকর্মের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।” রাজনীতিতে সৎ কার্যকলাপ নিশ্চিত করতে পারলে ধর্মের অপব্যবহার রোধ করা যায়।

 উপসংহার

সনাতন ধর্ম আমাদের শিক্ষা দেয়, ধর্ম মানবতার সেবা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার শুধুমাত্র সমাজকে বিভক্ত করে, যা সনাতন ধর্মের মূল দর্শনের বিপরীত। তাই, আমাদের প্রত্যেকের উচিত ধর্ম এবং রাজনীতির অপব্যবহার থেকে নিজেকে বিরত রাখা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top