রাজনীতি ও ধর্মকে সনাতন ধর্ম কীভাবে পৃথকভাবে দেখে?

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন যে রাজনীতি ও ধর্মকে আমরা কীভাবে একে অপরের থেকে পৃথকভাবে বিচার করতে পারি? সনাতন ধর্ম, যা বিশ্বব্যাপী প্রাচীনতম এবং সুপ্রতিষ্ঠিত জীবনধারা হিসাবে পরিচিত, এ বিষয়ে একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। আমি বিশ্বাস করি, সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায় যে রাজনীতি এবং ধর্ম একে অপরের পরিপূরক হলেও, তাদের ভূমিকা এবং উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। চলুন, এই বিষয়ে আমরা গভীরতর আলোচনা করি।

 ধর্ম ও রাজনীতির ভূমিকা

সনাতন ধর্মের মূল দর্শন বলে যে ধর্ম মানে “ধারণ করে যে” বা যা আমাদের মানবিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করে। ধর্ম আমাদের জীবনধারার প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা এবং ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, রাজনীতি হলো সমাজ পরিচালনার একটি কাঠামো যা ন্যায়বিচার এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে।

যেমন, ভগবদ্ গীতা বলে:

> “ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারতে, অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।” (গীতা ৪.৭)

এর অর্থ, যখনই ধর্মের অবনতি হয় এবং অধর্ম বৃদ্ধি পায়, তখন সৃষ্টিকর্তা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আবির্ভূত হন। এখান থেকে বোঝা যায় যে ধর্ম হলো মানুষের নৈতিকতা রক্ষা করা, আর রাজনীতি হলো সেই ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কাঠামো।

 রামের রাজনীতি এবং ধর্ম

রামায়ণে আমরা দেখি, শ্রী রাম একজন আদর্শ রাজা এবং ধর্মের রক্ষক ছিলেন। তিনি ধর্মের নীতি মেনে রাজ্য শাসন করেছিলেন এবং মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যখন সীতা হরণ হয়, তখন তিনি ব্যক্তিগত কষ্ট সরিয়ে রেখে রাজধর্ম পালন করেন। এটি আমাদের শেখায় যে রাজনীতি এবং ধর্ম একত্রে কাজ করতে পারে, তবে তারা তাদের নিজ নিজ সীমানা অতিক্রম করে না।

 ধর্মের স্বাধীনতা এবং রাজনীতির সীমানা

আপনারা কি জানেন, সনাতন ধর্ম কখনোই কারো উপর নিজের বিশ্বাস চাপিয়ে দেয় না? এটি বলে যে ধর্ম মানে ব্যক্তিগত মুক্তি এবং নৈতিকতার চর্চা।

> “একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি।” (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৬)

এর অর্থ, সত্য একটাই, তবে জ্ঞানীরা তাকে বিভিন্ন নামে ডাকে। এই শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ধর্ম আমাদের নিজস্ব উপলব্ধির বিষয়, এবং এটি রাজনীতির মতো জনজীবনের কাঠামোর সঙ্গে মেলানো উচিত নয়।

 বর্তমান পরিস্থিতি: ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণ

আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন, আজকের দিনে রাজনীতি এবং ধর্মের মধ্যে বিভাজন প্রায় অদৃশ্য। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করে। কিন্তু সনাতন ধর্ম এই প্রবণতাকে সমর্থন করে না। এটি বলে যে ধর্ম কখনো রাজনীতির হাতিয়ার হতে পারে না।

 উদাহরণ: মহাভারতের শিক্ষা

মহাভারতে আমরা দেখতে পাই, দুর্যোধন এবং কৌরবরা রাজনীতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে রূপ নেয়। অন্যদিকে, শ্রীকৃষ্ণ ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিলেন, যদিও তিনি সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি অর্জুনকে বলেছিলেন:

> “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহ।” (গীতা ৩.৩৫)

অর্থাৎ, নিজের ধর্ম পালনেই প্রকৃত কল্যাণ, অন্যের ধর্ম পালন সর্বদা বিপদের কারণ।

 সমকালীন উদাহরণ: রাজনীতি ও ধর্মের ভারসাম্য

আপনার জীবনে কি কখনো এমন পরিস্থিতি এসেছে যেখানে আপনি দ্বিধায় পড়েছেন ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে? উদাহরণস্বরূপ, আজকের সমাজে নাগরিকদের প্রায়ই সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোন নৈতিক ভিত্তি রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য। সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায়, নৈতিকতা কখনোই রাজনীতির বলি হওয়া উচিত নয়।

 ধর্ম ও রাজনীতি পৃথক রাখা কেন জরুরি?

ধর্ম এবং রাজনীতি যদি মিশে যায়, তাহলে ন্যায়বিচার এবং মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সনাতন ধর্ম এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়। যেমন:

> “অহিংসা পরমো ধর্মঃ।” (মহাভারত)

এর অর্থ, অহিংসাই সর্বোচ্চ ধর্ম। রাজনীতিতে যদি এই নীতি মানা হয়, তবে সমাজে শান্তি এবং সম্প্রীতি বজায় থাকবে।

 উপসংহার

আমরা যদি ধর্ম এবং রাজনীতিকে তাদের নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে দিই, তাহলে সমাজে ভারসাম্য বজায় থাকবে। সনাতন ধর্ম আমাদের দেখায়, কীভাবে নৈতিকতা, ন্যায়বিচার, এবং মানবিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top