পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্বকে বোঝা এবং তা পালন করা সনাতন ধর্মের একটি মুলনীতিগত অংশ। আমি বিশ্বাস করি, আপনি যদি প্রকৃতিকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন এবং ধর্মীয় অনুশাসনগুলোকে মেনে চলেন, তবে আপনি পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। আসুন, সনাতন ধর্ম কীভাবে আমাদের প্রকৃতির সুরক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে এবং পরিবেশগত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সাহায্য করে তা নিয়ে আলোচনা করি।
প্রকৃতি ও সনাতন ধর্মের সম্পর্ক
আমরা জানি, সনাতন ধর্ম প্রকৃতি ও জীবনের সমন্বয়ের কথা বলে। ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে:
“মাতা ভূমি: পুত্রোহং পৃথ্ব্যাঃ”
অর্থাৎ, “পৃথিবী আমাদের মা এবং আমরা তার সন্তান।”
আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, মা যদি আমাদের ভালোবাসেন, তবে তার প্রতি আমাদের দায়িত্ব কতখানি? সনাতন ধর্ম আমাদের শিখিয়েছে, পরিবেশকে শ্রদ্ধা করতে এবং তার সুরক্ষায় কাজ করতে।
পরিবেশ রক্ষায় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান
সনাতন ধর্মে এমন অনেক আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে যা পরিবেশ রক্ষায় সাহায্য করে। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি:
- তুলসী পূজা:
তুলসী গাছকে সনাতন ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয়। আমি নিজেও প্রতিদিন সকালে তুলসী গাছের কাছে প্রার্থনা করি। তুলসী শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি পরিবেশগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাতাস পরিশোধন করে এবং আমাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। - পিপল গাছের রক্ষণাবেক্ষণ:
পিপল গাছ, যাকে আমরা “অশ্বত্থ” বলি, দিনরাত অক্সিজেন প্রদান করে। সনাতন ধর্মে পিপল গাছের পূজা করার বিধান রয়েছে, যা মানুষকে এই গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। আপনি যদি এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন, তবে নিশ্চয়ই এই গাছ সংরক্ষণে এগিয়ে আসবেন। - যজ্ঞ এবং হোম:
যজ্ঞের মাধ্যমে পরিবেশে বিশুদ্ধতা আনা হয়। বেদে বলা হয়েছে:
“ইষে ত্বোর্জে ত্বা, বায়ব স্থ দেব ভৃয়ঃ।”
অর্থাৎ, “যজ্ঞের ধোঁয়া পরিবেশের বিশুদ্ধতা রক্ষা করে।”
যজ্ঞের মাধ্যমে পরিবেশে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব কমে, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সনাতন ধর্মের মুলনীতি
সনাতন ধর্মে পরিবেশ রক্ষার যে আদর্শ রয়েছে, তা পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এখানে কয়েকটি মূলনীতি তুলে ধরা হলো:
- অহিংসা (প্রাণীদের প্রতি দয়া):
গীতায় বলা হয়েছে:
“আহিংসা পরম ধর্মঃ।”
অহিংসা শুধুমাত্র মানুষের প্রতি নয়, প্রকৃতির প্রতিও প্রযোজ্য। আপনি যদি একটি গাছ কেটে ফেলেন বা জল দূষিত করেন, তবে আপনি প্রকৃতির প্রতি হিংসা করছেন। এটি বন্ধ করা আমাদের দায়িত্ব।
- সংযম (উপভোগে সীমাবদ্ধতা):
আপনি যদি নিজের চাহিদা সীমিত করেন এবং প্রকৃতির প্রতি লোভ কমান, তবে এটি পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। ঋষিদের মতো সরল জীবন যাপন আমাদের এই শিক্ষা দেয়। - পরমার্থ (সকলের কল্যাণ):
সনাতন ধর্মের মতে, প্রকৃতি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, এটি সবার জন্য। ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন:
“তত্ত্ব-অর্থং ভূমে সর্ভস্যার্থং।”
অর্থাৎ, “যে জিনিস প্রকৃতির, তা সবার।”
এটি আমাদের শেখায়, প্রকৃতির সম্পদ কেবল নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করা নয়, সকলের প্রয়োজনে সঠিকভাবে ব্যবহার করা উচিত।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ
- আমি যখন পলিথিন ব্যাগের পরিবর্তে কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করতে শুরু করলাম, তখন আমার চারপাশে মানুষও তা অনুসরণ করতে শুরু করল।
- বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার জন্য ছোট ট্যাংক তৈরি করেছি। এটা আপনারাও করতে পারেন। এতে শুধু পানির অপচয় রোধ হয় না, বরং পরিবেশ রক্ষায়ও সাহায্য করে।
- নিজের বাড়িতে সোলার প্যানেল বসিয়ে আমি বিদ্যুতের অপচয় কমিয়েছি। সনাতন ধর্মের “পরমার্থ” নীতির আলোকে এটি একটি ছোট কিন্তু কার্যকরী পদক্ষেপ।
পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব
আমি মনে করি, পরিবেশের প্রতি আপনার ভালোবাসা এবং দায়িত্ব পালন হল সনাতন ধর্মের একটি প্রধান শিক্ষা। আমাদের প্রত্যেকের উচিত প্রকৃতিকে মা হিসেবে গ্রহণ করা এবং তার যত্ন নেওয়া।
শেষ করার আগে আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই: “আপনি কি এমন কিছু করতে পারবেন যাতে প্রকৃতি আপনার জন্য গর্বিত হতে পারে?”
সনাতন ধর্মের মুলনীতি আপনাকে এই পথ দেখাবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করি এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ি।
জয় শ্রী কৃষ্ণ!