জীবজন্তুর প্রতি সনাতন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি কী?

সনাতন ধর্ম, যা হিন্দু ধর্ম নামেও পরিচিত, আমাদের প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা এবং জীবজন্তুর প্রতি মমত্ববোধের শিক্ষা দেয়। জীবজন্তুর প্রতি আচরণ কেবল আমাদের চারপাশের পরিবেশকেই নয়, আমাদের আত্মার বিকাশকেও প্রভাবিত করে। আপনি যদি সনাতন ধর্মের নীতিতে বিশ্বাস করেন, তবে আপনি জানেন যে এই ধর্মের মূল শিক্ষা হলো সবার প্রতি দয়া এবং সম্মান প্রদর্শন করা।

সনাতন ধর্মে জীবজন্তুর স্থান

সনাতন ধর্মের প্রাচীন শাস্ত্রগুলো জীবজন্তুকে শ্রদ্ধা এবং যত্ন করার শিক্ষা দেয়। আপনি যদি মহাভারত, রামায়ণ, বা বেদ পড়েন, সেখানে আপনি দেখবেন কীভাবে জীবজন্তুকে প্রকৃতির অপরিহার্য অংশ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।

শাস্ত্র অনুযায়ী, জীবজন্তুরাও আত্মার অধিকারী। যেমন বৃদ্ধিকাণ্ড উপনিষদ বলে:

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”
(এই বিশ্বজগৎ ব্রহ্মময়, অর্থাৎ প্রতিটি জীব, গাছপালা এবং প্রাণী সেই একই ব্রহ্মের অংশ।)

আপনার এবং আমার জন্য এটি একটি শিক্ষা: জীবজন্তুকে কেবল জীব হিসেবে নয়, বরং ঈশ্বরের সৃষ্টি হিসেবে দেখার।

উদাহরণ : গরু

গরুকে সনাতন ধর্মে “গোমাতা” বলা হয়। কারণ এটি কেবল আমাদের দুধ, সার এবং চাষাবাদের উপকরণ সরবরাহ করে না, বরং এর প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। গরুর গুরুত্ব নিয়ে গরুড় পুরাণে বলা হয়েছে:

“গাবোহি সন্তু নিরপদাঃ”
(গরুরা যেন সব সময় সুরক্ষিত থাকে।)

আপনি যদি একটি গরুর যত্ন করেন, তাহলে আপনি প্রকৃতপক্ষে আপনার আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটাচ্ছেন।

উদাহরণ : হংস বা রাজহাঁস

হংসকে জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। মহাভারতে হংসের চরিত্র থেকে বুদ্ধিমত্তা, শুদ্ধি এবং সততার শিক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। হংস কেবল জল থেকে দুধ আলাদা করার ক্ষমতার জন্যই নয়, তার আচার-ব্যবহারের জন্যও বিখ্যাত।

আপনার জীবনেও কি হংসের মতো বৈশিষ্ট্য আনতে চান? এই প্রশ্ন আপনার নিজেকে জিজ্ঞাসা করা উচিত।

উদাহরণ : বাঁদর

রামায়ণে হনুমানকে দেখে আপনি শিখতে পারেন কীভাবে বিশ্বাস, নিষ্ঠা এবং সাহস জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে। হনুমানকে জীবজন্তু হিসেবে না দেখে, একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষক হিসেবে মানুন। তাঁর সম্পর্কে বাল্মীকি রামায়ণ বলে:

“যথা রামাঃ তথা হরিঃ”
(যেখানে রাম, সেখানে হনুমান।)

আপনি যদি জীবজন্তুর প্রতি স্নেহ এবং বিশ্বাস প্রদর্শন করেন, আপনার জীবনেও এমন পরিবর্তন আসবে।

জীবজন্তুর প্রতি দয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ

আপনার দৈনন্দিন জীবনে এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। ধরুন, আপনি একটি পাখি বা কুকুরের প্রতি যত্নশীল। আপনি যদি তাদের খাবার দেন বা তাদের সুরক্ষিত রাখেন, তবে আপনি প্রকৃত অর্থে আপনার ধর্ম পালন করছেন।

মনু স্মৃতি বলে:

“অহিংসা পরমো ধর্মঃ”
(অহিংসাই সর্বোচ্চ ধর্ম।)

জীবজন্তুর প্রতি দয়া দেখানো আপনার হৃদয়ে অহিংসার বীজ বপন করবে।

পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজন

সনাতন ধর্মের একটি মূলমন্ত্র হলো পৃথিবী এবং জীবজন্তুর প্রতি দায়িত্ব পালন করা। আমরা যদি জীবজন্তুকে সুরক্ষিত না রাখি, তবে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হবে। ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে:

“মাতাভূমিঃ পুত্রোহং পৃথিব্যাঃ”
(পৃথিবী আমার মা এবং আমি তার সন্তান।)

আপনার এবং আমার জন্য এটি স্পষ্ট নির্দেশনা: জীবজন্তুর সুরক্ষা করা মানেই প্রকৃতিকে রক্ষা করা।

শেষ কথা

জীবজন্তুর প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? আপনি কি তাদের ঈশ্বরের অংশ হিসেবে দেখেন, নাকি শুধুই জীবনের এক অংশ? ভাবুন, আপনার প্রতিদিনের কাজ কীভাবে তাদের উপর প্রভাব ফেলে।

আমাদের ধর্মের শিক্ষা যদি আপনি বাস্তবে প্রয়োগ করেন, তবে আপনি একদিকে প্রকৃতি ও জীবজন্তুর সুরক্ষা করবেন, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক সুখও অর্জন করবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top