নদী, সনাতন ধর্মে, শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ নয়; এটি আমাদের জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদীকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে—মা যেমন আমাদের জন্ম দেয়, নদীও আমাদের জীবন জোগায়। তাই আমি যখন ভাবি, নদীর দূষণ প্রতিরোধের জন্য সনাতন ধর্মে কী কী নিয়ম বা সংস্কার আছে, তখন মনে হয়, এই ধর্মের মূল শিক্ষা এবং রীতিনীতি আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করারই নির্দেশ দেয়।
সনাতন ধর্মে নদীর গুরুত্ব
সনাতন ধর্মে নদী শুধুমাত্র জলধারার উৎস নয়, এটি পবিত্রতার প্রতীক। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, নর্মদা, গোদাবরী, কাবেরী এবং সিন্ধুর মতো নদীগুলি আমাদের ধর্মগ্রন্থে দেবী রূপে পূজিত হয়। গঙ্গাকে বলা হয় “গঙ্গা মাতা”, যার স্পর্শে পাপমুক্তি ঘটে। আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন “গঙ্গা স্নান” করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির কথা।
দূষণ প্রতিরোধের প্রাচীন শিক্ষা
সনাতন ধর্মে নদীর প্রতি যত্নশীল হওয়ার বিষয়ে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। এখানে আমি কয়েকটি উল্লেখ করছি:
- যজ্ঞ ও হোমের আচার:
ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে গঙ্গা জল ব্যবহার করা হয়, কারণ এটি পবিত্র এবং জীবনের প্রতীক। “আপঃ শান্তি স্তোত্র” মন্ত্রে বলা হয়েছে,
“আপঃ ওষধয়ঃ শন্তি।”
অর্থাৎ, জলই জীবনের চিকিৎসক। এটি পরিষ্কার রাখা আমাদের কর্তব্য। - নদীতে বর্জ্য না ফেলা:
আপনি যদি কোনো পুরাণ পড়ে থাকেন, তবে দেখবেন যে নদীর পাশে বসবাসকারী মানুষেরা সবসময় নদীকে দেবী জ্ঞান করে পূজা করতেন এবং কোনো অপবিত্র পদার্থ নদীতে ফেলতেন না। যেমন মনুসংহিতা (4.56) নির্দেশ দেয়,
“জলাশয়ে বর্জ্য ফেলা পাপ এবং এই পাপ জীবনে কষ্ট নিয়ে আসে।” - পুষ্প ও মালার প্রথা:
হিন্দু ধর্মে নদীতে ফুল বা মালা অর্পণ করার রীতি রয়েছে। তবে এতে বলা হয়, আপনি এমন কিছু দেবেন না যা পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বর্তমানে প্লাস্টিক বা কৃত্রিম উপাদান থেকে দূরে থাকার বার্তা এই রীতি থেকেই আসে। - নদীর পাড়ে তীর্থযাত্রা ও সাধনায় নিয়ম:
গঙ্গা, যমুনা বা নর্মদার মতো নদীর তীরে তীর্থযাত্রার সময় মানুষ শপথ নিতেন নদীকে পবিত্র রাখার। তারা কখনোই কোনো বিষাক্ত বা অবাঞ্ছিত পদার্থ নদীতে ফেলতেন না। আপনি যদি কাশীতে যান, সেখানে আজও এই রীতি বজায় আছে।
আধুনিক যুগে ধর্মের শিক্ষা ও দূষণ প্রতিরোধ
আজকের যুগে, নদীর দূষণ আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, প্লাস্টিক, রাসায়নিক বর্জ্য এবং অপ্রয়োজনীয় পদার্থ নদীতে ফেলে আমরা প্রকৃতিকে বিপর্যস্ত করছি। অথচ সনাতন ধর্ম আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করারই শিক্ষা দেয়।
- গঙ্গা নদীর পরিচ্ছন্নতা অভিযান:
গঙ্গা পবিত্রতা বজায় রাখতে আধুনিক ভারতের “নমামি গঙ্গে” প্রকল্প সরাসরি সনাতন ধর্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত। এই প্রকল্পটি আমাদের শেখায়, ধর্মের নামে নদীকে দূষিত না করে, বরং তাকে সুরক্ষিত রাখতে আমরা সক্রিয় হই। - প্লাস্টিক মুক্ত পূজা:
আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, অনেক জায়গায় এখন প্লাস্টিক মুক্ত পূজা ব্যবস্থা চালু হয়েছে? এটি সনাতন ধর্মের পরিবেশ সচেতন রীতির আধুনিক রূপ। - প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পূজা সামগ্রীর ব্যবস্থাপনা:
গঙ্গা তীরে এমন অনেক উদ্যোগ দেখা যায় যেখানে পূজা সামগ্রী পুনঃব্যবহারযোগ্য পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপনা করা হয়। আপনি নিজেও এ ধরনের উদ্যোগে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
আমি কীভাবে নদীকে রক্ষা করতে পারি?
আপনার মনে হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে, আপনি একা কী করবেন? তবে সনাতন ধর্ম আমাদের শিক্ষা দেয়,
“পরিবর্তন শুরু হয় নিজের কাছ থেকে।”
- নদীতে আবর্জনা না ফেলা:
আপনার বাড়ির আবর্জনা বা পূজা সামগ্রী নদীতে না ফেলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণ করুন। - অন্যকে সচেতন করা:
আপনার পরিবার ও সমাজে নদীর গুরুত্ব এবং দূষণ প্রতিরোধের উপায় নিয়ে আলোচনা করুন। - পরিবেশবান্ধব জীবনধারা গ্রহণ:
পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল জীবনযাপন শুরু করুন। এটি সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা।
উপসংহার
সনাতন ধর্মে নদী শুধুমাত্র প্রাকৃতিক উপাদান নয়, এটি জীবনের স্রোতধারা। আমরা যদি সত্যিই ধর্মের পথ অনুসরণ করি, তবে নদীকে পবিত্র ও সুরক্ষিত রাখা আমাদের দায়িত্ব।
আপনি কি ভাবতে পারেন, এক পবিত্র নদী কীভাবে আমাদের জীবনকে পবিত্র ও সমৃদ্ধ করতে পারে, যদি আমরা একে দূষণমুক্ত রাখি? আসুন, আমরা সকলে মিলে নদী রক্ষার শপথ নিই এবং সনাতন ধর্মের শিক্ষাকে জীবনে প্রয়োগ করি।