স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা বৃদ্ধিতে সনাতন ধর্ম কী নির্দেশনা দেয়?

আমাদের জীবনধারা এবং সম্পর্কের ওপর সনাতন ধর্মের দিকনির্দেশনা গভীর এবং যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তো কেবল একটি সামাজিক বন্ধন নয়, এটি এক পবিত্র দায়িত্ব এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের মিশ্রণে গঠিত। সনাতন ধর্মে এই সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে নানা শাস্ত্র এবং নির্দেশনা। যদি তুমি নিজের বিবাহিত জীবনকে সুখী এবং শান্তিময় করতে চাও, তবে সনাতন ধর্মের এই মূল্যবান শিক্ষাগুলো তোমার জন্য খুবই কার্যকর।

 ধর্মপত্নী ও ধর্মপতির ভূমিকা

“পতি” শব্দের অর্থই হলো রক্ষক, এবং “পত্নী” শব্দের অর্থ হলো সঙ্গিনী। সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, “যথা চ সংজগত: স্থিতিরূপা পত্নী, তথা চ ধর্মপতির কর্তব্য।” অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেন পৃথিবীর দুই মেরুর মতো ভারসাম্যপূর্ণ।

উদাহরণ:

মহাভারতে দেখা যায় যে, দ্রৌপদী কেবল পাণ্ডবদের স্ত্রী ছিলেন না; তিনি তাঁদের জীবনের সাফল্য এবং নৈতিকতার মূল চালিকা শক্তি ছিলেন। আর পাণ্ডবরা তাঁকে সবসময় শ্রদ্ধা করেছেন এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন। এটি একটি আদর্শ উদাহরণ যা আমাদের সম্পর্কের শিক্ষা দেয়।

 পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা

গৃহস্থ জীবনে শ্রদ্ধার স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনু স্মৃতিতে বলা হয়েছে:

“যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।”

অর্থাৎ যেখানে নারীদের পূজা করা হয়, সেখানে দেবতারা বাস করেন। স্বামীকে স্ত্রীকে সর্বদা শ্রদ্ধা করতে হবে এবং স্ত্রীকেও স্বামীর প্রতি অনুগত ও সহানুভূতিশীল হতে হবে। এটি একে অপরের প্রতি গভীর সম্মানের মাধ্যমে সম্ভব।

উদাহরণ:

শ্রী রাম এবং সীতা এই শ্রদ্ধার সর্বোত্তম উদাহরণ। সীতার প্রতি রামের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা তাঁদের সম্পর্ককে মহৎ করে তুলেছিল। একইভাবে, সীতাও রামের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত নিবেদিত।

 পরস্পরের কর্তব্যবোধ

গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:

“স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ।”

অর্থাৎ নিজের কর্তব্য পালনই শ্রেয়। স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই একে অপরের প্রতি দায়িত্ব পালন করা উচিত। স্বামীকে পরিবারের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে, আর স্ত্রীকে সেই পরিবারের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য রক্ষা করতে হবে। যখন উভয়েই নিজেদের কর্তব্যে অবিচল থাকে, তখন সম্পর্ক মজবুত হয়।

উদাহরণ:

সভ্যতার আদিকালে, সতী-অনুসূয়া ছিলেন এমন এক স্ত্রী যিনি নিজের ধর্ম পালন করে স্বামীর জন্য তপস্যা করেছিলেন। তাঁর এই কর্তব্যপরায়ণতা তাঁকে দেবতাদের কাছেও পূজনীয় করে তুলেছিল।

 সম্পর্কের মধ্যে সত্যতা এবং বিশ্বাস

সনাতন ধর্মে সত্যকে সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

“সত্যং পরং ধর্মঃ।”

অর্থাৎ সত্যই পরম ধর্ম। যদি স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি সত্যবাদী হয় এবং কোনও মিথ্যা বা লুকোচুরি না থাকে, তবে সম্পর্কের ভিত্তি হবে অটুট।

উদাহরণ:

রাজা হরিশচন্দ্র এবং তাঁর স্ত্রী তারা সত্যের জন্য তাঁদের সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন। তাঁদের জীবনের শিক্ষাটি আজও আমাদের বলে যে সত্য সর্বদা সম্পর্ককে দৃঢ় করে।

 ক্ষমা এবং নম্রতা

মানবসম্পর্কে ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষমা এবং নম্রতা সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করে। মহাভারতে বলা হয়েছে:

“ক্ষান্তির মূল্য অপরিসীম।”

ক্ষান্তি বা ক্ষমা শুধু সম্পর্ককে রক্ষা করে না, বরং সেটিকে আরও গভীর এবং মজবুত করে তোলে।

উদাহরণ:

পাণ্ডু এবং মাদ্রীর সম্পর্কেও এমন ক্ষমার উদাহরণ দেখা যায়। পাণ্ডুর জীবনে বহু চ্যালেঞ্জ থাকলেও মাদ্রী সবসময় ক্ষমাশীল এবং ধৈর্যশীল ছিলেন।

 পরস্পরের প্রতি সময় দান

কোনো সম্পর্কেই সময় দেওয়া ছাড়া ভালোবাসা এবং বোঝাপড়া গড়ে ওঠে না। সনাতন ধর্মের মতে, সংসার এক ধরণের যোগ। আর যোগে পরস্পরের সঙ্গে সময় কাটানো অপরিহার্য।

উদাহরণ:

কৃষ্ণ এবং রুক্মিণীর সম্পর্ক এমন এক যোগের উদাহরণ। কৃষ্ণ তাঁর সমস্ত দায়িত্বের পাশাপাশি রুক্মিণীর প্রতি সময় দিতেন এবং তাঁর মনের কথা শুনতেন। এটি তাঁদের সম্পর্ককে আরও সুন্দর করে তুলেছিল।

উপসংহার

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হলো দুটি আত্মার মিলন। সনাতন ধর্মে এই সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যদি তুমি নিজের জীবনে এই শিক্ষাগুলো গ্রহণ করো, তবে নিশ্চিতভাবে তোমার সম্পর্ক আরও সুন্দর হবে।

তুমি কি মনে করো সনাতন ধর্মের এই শিক্ষাগুলো আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক? তুমি কি নিজের সম্পর্কে এই নির্দেশনাগুলো প্রয়োগ করতে প্রস্তুত? ভেবে দেখো এবং জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top