সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের আচরণ কেমন হওয়া উচিত বলে সনাতন ধর্ম বলে?

জীবনের প্রতিটি অধ্যায়েই আমাদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব অপরিসীম। বাবা-মা হিসেবে সন্তানদের প্রতি আমাদের আচরণ যেন সঠিক পথ দেখাতে পারে, এটাই সনাতন ধর্মের এক গভীর বার্তা। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব, সনাতন ধর্মের আদর্শ অনুযায়ী বাবা-মায়ের আচরণ কেমন হওয়া উচিত।

সন্তানদের প্রতি আদর্শ আচরণের গুরুত্ব

সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি হল ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। এই চারটি স্তম্ভের মধ্যে ধর্ম প্রথম স্থান পায়, কারণ ধর্মই জীবনের সঠিক পথ দেখায়। “মাতৃপিতৃভক্তি” সনাতন ধর্মের এক বিশেষ আদর্শ, যা সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের আচরণের মূলভিত্তি। বাবা-মা যেন সন্তানের প্রতি আদর্শ আচরণ করেন, যাতে সন্তান জীবনে সৎপথে এগিয়ে যেতে পারে।

উপনিষদের শিক্ষা: আদর্শ সম্পর্কের ভিত্তি

উপনিষদ বলে, “মাতৃ দেবো ভব, পিতৃ দেবো ভব।” অর্থাৎ মা ও বাবা দেবতুল্য। কিন্তু এই দেবতুল্য আচরণ করতে গেলে আমাদের মনোভাব ও কর্ম হতে হবে নিঃস্বার্থ। সন্তানকে নিছক নিজের সম্পত্তি ভাবা সনাতন ধর্মে গ্রহণযোগ্য নয়। বরং সন্তানের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে তাদের প্রতি আচরণ করতে বলা হয়েছে।

প্রাচীন যুগে ধ্রুবের কাহিনী

ধ্রুবের গল্প আমরা সবাই জানি। যখন তার সৎমা তাকে রাজসিংহাসনে বসতে বাধা দেয়, তখন সে তার মায়ের উৎসাহে ভগবানের আরাধনায় মনোনিবেশ করে। এখানে মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের প্রতি মা বা বাবার আশীর্বাদ এবং সঠিক দিকনির্দেশনা কিভাবে জীবনের সমস্যাগুলিকে সমাধান করতে সাহায্য করে, এই কাহিনী থেকে তা স্পষ্ট।

মহাভারতের শিক্ষা: ধৈর্য ও সহনশীলতা

মহাভারতে পাণ্ডবরা যুধিষ্ঠিরের নেতৃত্বে সততা, ধৈর্য ও কর্তব্যপরায়ণতার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের মা কুন্তী সবসময় তাদের সঠিক পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কুন্তী দেবী বলেন, “সত্যই ধর্ম, এবং ধর্মই সর্বোচ্চ।” সন্তানকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চালিত করার এই শিক্ষা বাবা-মায়ের অন্যতম দায়িত্ব।

যুধিষ্ঠিরের সততা

যুধিষ্ঠির একবার শিকার করতে গিয়ে একটি নিরীহ পাখি হত্যা করতে চাননি, কারণ তার মা তাকে জীবের প্রতি দয়া শেখান। এই শিক্ষা আজকের যুগেও সমান প্রাসঙ্গিক। সন্তানকে দয়া, সততা ও ধৈর্য শেখানোই সনাতন ধর্মের শিক্ষা।

গীতার উপদেশ: প্রত্যেকের কর্তব্য

ভগবদ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ।” নিজের ধর্ম বা কর্তব্য পালন করাই শ্রেষ্ঠ। বাবা-মা হিসেবে আমাদের কর্তব্য হল সন্তানদের সঠিক শিক্ষা প্রদান করা, তাদের জীবনে সৎপথের প্রতি আগ্রহী করা।

কৃষ্ণ ও সুধামার বন্ধুত্ব

কৃষ্ণ যখন সুধামার দারিদ্র্য দূর করতে সাহায্য করেন, তখন তিনি বন্ধুত্বের মহিমা তুলে ধরেন। এই গল্প থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

সনাতন ধর্মে আদর্শ আচরণের মূলনীতি

  •  ভালোবাসা ও দয়া: সন্তানকে ভালোবাসা ও দয়ার মাধ্যমে সঠিক পথ দেখাতে হবে। শ্রী রামকৃষ্ণ বলেন, “যে দয়া করে, সে ঈশ্বরের নিকটবর্তী।”
  •  শিক্ষা ও জ্ঞান: সন্তানকে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, নৈতিক শিক্ষাও দিতে হবে।
  •  সমতা: পুত্র-কন্যার মধ্যে কোনো বৈষম্য রাখা উচিত নয়। ঋগ্বেদ বলে, “নারী এবং পুরুষ একই সৃষ্টিকর্তার অংশ।”
  •  স্বাধীনতা: সন্তানকে নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। তবে তাদেরকে সঠিক উপায়ে সেই সিদ্ধান্ত নিতে শেখাতে হবে।

আধুনিক যুগে সনাতন ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা

আজকের যুগে প্রযুক্তি, প্রতিযোগিতা এবং জীবনের ব্যস্ততার মাঝে সনাতন ধর্মের আদর্শ আমাদের সন্তানদের সঠিক পথে চালিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা সন্তানকে শিখাই যে “কর্মই ধর্ম,” তবে তারা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে।

সেবার গুরুত্ব

গুরু নানকের একটি কথা মনে রাখা দরকার, “সেবা করা ঈশ্বরের আরাধনা করার সমান।” যদি বাবা-মা সন্তানকে সমাজের সেবা করার শিক্ষা দেন, তবে তারা নিশ্চিতভাবে আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠবে।

পরিকল্পিত আচরণের জন্য করণীয়

  •  প্রতিদিনের আচরণে স্থিরতা রাখা: বাবা-মা যদি প্রতিদিন ধৈর্য ধরে সন্তানকে বোঝান, তবে সন্তান সঠিক শিক্ষায় গড়ে উঠবে।
  •  আধ্যাত্মিক চর্চার পরিচয়: সন্তানকে প্রতিদিন প্রার্থনা করতে উদ্বুদ্ধ করা।
  •  ভুলের প্রতি সহনশীলতা: সন্তান ভুল করলে ধমক না দিয়ে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করুন।
  •  ব্যক্তিত্বের বিকাশে সাহায্য: সন্তানদের স্বাধীনভাবে নিজেদের চিন্তা-ভাবনা গড়ে তুলতে সহায়তা করুন।

উপসংহার

সনাতন ধর্মের মতে বাবা-মায়ের আচরণ যেন সবসময় প্রেম, সহনশীলতা ও সঠিক দিকনির্দেশনায় পূর্ণ হয়। সন্তানরা যেন তাদের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করে। আপনার সন্তানের প্রতি আপনি কীভাবে আচরণ করেন, তা তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।

ভাবুন তো, যদি প্রতিটি বাবা-মা তাদের সন্তানকে সনাতন ধর্মের আদর্শে গড়ে তোলেন, তবে এই পৃথিবী কতটা শান্তি ও সুখে পূর্ণ হতে পারে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top