সনাতন ধর্মে পরিবার একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত। পরিবার কেবল রক্তের সম্পর্ক নয়, এটি আমাদের মানসিক, আধ্যাত্মিক, এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার কেন্দ্র। পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যদের প্রতি যত্ন এবং দায়িত্ব পালন সনাতন ধর্মের অন্যতম প্রধান শিক্ষাগুলির মধ্যে একটি।
“মাতৃপিতৃভক্তি”: শাস্ত্রের নির্দেশ
শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “মাতৃ দেবো ভব, পিতৃ দেবো ভব।” এটি আমাদের শেখায় যে মা-বাবা ঈশ্বরের সমতুল্য। তাদের সেবা করা ঈশ্বরের সেবা করার মতোই পুণ্যের কাজ। গৃহস্থ জীবনে এটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আপনি যদি আপনার পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যদের প্রতি যত্নশীল না হন, তবে আপনার ধর্ম পালনও অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
শ্রাবণের কুমার
শ্রাবণের কুমার ছিলেন এমন এক আদর্শ পুত্র, যিনি তার বৃদ্ধ মা-বাবাকে কাঁধে করে তীর্থযাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তার জীবনের এই ঘটনা আমাদের শেখায়, যত কষ্টই হোক না কেন, মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালন কখনো এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।
আপনার কর্তব্য কীভাবে পালন করবেন?
সনাতন ধর্মে বৃদ্ধ সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব পালন কয়েকটি মূলনীতির মাধ্যমে নির্দেশিত হয়েছে।
- সম্মান প্রদর্শন: বৃদ্ধ সদস্যদের প্রতি সম্মান দেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেন, তবে তারা মানসিক শান্তি পাবেন।
- শারীরিক যত্ন: বৃদ্ধ বয়সে শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, স্বাস্থ্যকর খাবার এবং আরামের ব্যবস্থা করা আমাদের কর্তব্য।
- আধ্যাত্মিক সহায়তা: তাদের সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনায় অংশ নেওয়া, ভক্তিমূলক গান শোনা এবং পবিত্র গ্রন্থ পড়ে শোনানো তাদের মানসিক শান্তি দেয়।
শ্রীরামচন্দ্রের আদর্শ
রামচন্দ্র নিজের রাজ্য ত্যাগ করে বনবাসে গিয়েছিলেন পিতার আদেশ পালনের জন্য। তিনি দেখিয়েছিলেন, পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনই জীবনের আসল ধর্ম। এই ঘটনাটি আমাদের শেখায়, যত বড় ত্যাগই করতে হয়, পিতামাতার ইচ্ছার সম্মান করতে হবে।
শাস্ত্রীয় উক্তি যা আমাদের পথ দেখায়
- গীতার নির্দেশ: “যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতার সেবা করে, সে এই পৃথিবীতে এবং পরজীবনে সুখী হয়।”
- মনুস্মৃতি: “মাতা ও পিতার সেবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কর্ম। এতে সকল পাপ দূর হয়।”
- যোগবশিষ্ট: “বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের সমান।”
ভীষ্ম পিতামহ
ভীষ্ম পিতামহ তার পিতার সুখের জন্য আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করেছিলেন। এটি আমাদের শেখায়, পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হলে কখনো কখনো বড় ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত থাকতে হয়।
বৃদ্ধ সদস্যদের প্রতি অবহেলা: ফল কী?
গৃহস্থ জীবনে বৃদ্ধদের প্রতি অবহেলা করলে তার পরিণতি খুবই করুণ হতে পারে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অবহেলা করে, সে তার জীবনের সকল সুখ হারায়।” আপনার পরিবারে যদি বৃদ্ধ সদস্যরা অবহেলিত হন, তবে তা আপনার ব্যক্তিগত জীবনেও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
মহাভারতের শিক্ষা
মহাভারতে গন্ধারী তার পুত্রদের বলেছিলেন, “যে সন্তান তার পিতার ইচ্ছা পূরণ করে না, সে কখনো রাজ্যে শাসন করতে পারে না।” বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি সম্মান ও দায়িত্ব পালন না করলে জীবনে উন্নতি সম্ভব নয়।
আপনি কীভাবে তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করবেন?
- সময় দিন: বৃদ্ধ সদস্যদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো সময়। তাদের সঙ্গে সময় কাটানো তাদের মানসিক শান্তি বৃদ্ধি করে।
- তাদের মতামত নিন: গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের মতামত জিজ্ঞাসা করুন। এতে তারা পরিবারের অংশ বলে অনুভব করবেন।
- ধৈর্য ধরুন: বৃদ্ধ বয়সে মানুষ অনেক সময় ছেলেমানুষি আচরণ করে। এমন পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন।
আধুনিক যুগে শ্রদ্ধার গুরুত্ব
আজকের ব্যস্ত জীবনে আমরা প্রায়ই বৃদ্ধদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ভুলে যাই। কিন্তু মনে রাখবেন, তারা আমাদের অতীত এবং বর্তমানের সেতুবন্ধন। তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনে দিশা দেখাতে পারে।
শেষ কথা
সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায়, বৃদ্ধ পিতা-মাতা বা পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব পালন ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের মতোই পবিত্র। আপনার কর্ম এবং ভালোবাসার মাধ্যমে যদি তাদের সুখী করতে পারেন, তবে তা আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হবে।
আপনি কি আজই আপনার পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটাবেন? তাদের সেবা করার মাধ্যমে ঈশ্বরের আশীর্বাদ গ্রহণ করুন।