পরিবারে সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া আজকের দিনে খুবই সাধারণ ঘটনা। এই পরিস্থিতি অনেক সময়ই আমাদের মনে প্রশ্ন তোলে—কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়? সনাতন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, এই বিষয়ের একটি গভীর এবং অন্তর্নিহিত সমাধান পাওয়া সম্ভব। আমি আজ আপনাকে বলব কীভাবে সনাতন ধর্মের মূলনীতি এবং শাস্ত্র অনুসরণ করে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ নিরসন করা যায়।
ধর্মের শাস্ত্র কী বলে?
সনাতন ধর্মে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল, “ধর্মে স্থিত হয়ে কর্তব্য পালন।” মহাভারতে আমরা দেখতে পাই যে, পাণ্ডবরা এবং কৌরবদের মধ্যেও সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ হয়েছিল। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বারবার ধর্মের পথে থাকার উপদেশ দিয়েছেন। শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতায় বলা হয়েছে:
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥”
(গীতা ৪.৭)
অর্থাৎ, যখনই ধর্মের অবক্ষয় হয় এবং অধর্ম বৃদ্ধি পায়, তখনই আমি নিজেকে প্রকাশ করি।
এই শ্লোকের বার্তা হল, আমাদের জীবনের যে কোনও পরিস্থিতিতে ধর্মের পথ অনুসরণ করা উচিত।
সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের মূল কারণ কী?
আমরা যদি সনাতন ধর্মের আলোকে চিন্তা করি, তবে বুঝতে পারি যে, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের মূল কারণ হচ্ছে লোভ এবং অহংকার। উপনিষদে বলা হয়েছে:
“তৈত্তিরীয় উপনিষদে রয়েছে:
‘মা gridhah kasya swid dhanam।’
অর্থাৎ, কোনও ব্যক্তির সম্পত্তির প্রতি লোভ করো না।”
লোভ এবং অহংকার আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। পরিবারে সম্পত্তি বিতরণের সময় যদি সবাই নিজেদের লাভ-ক্ষতির হিসাব না করে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করে, তাহলে বিরোধ হওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
বাস্তব উদাহরণ
রামায়ণ থেকে শিক্ষা
রামচন্দ্রের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল ত্যাগ। যখন কৈকেয়ী রামের জন্য সিংহাসন বঞ্চনা দাবি করলেন, তখন রামচন্দ্র আনন্দের সঙ্গে বনবাস গ্রহণ করেন। তিনি সম্পত্তি বা রাজত্বের জন্য ঝগড়া করেননি। এর মাধ্যমে তিনি আমাদের দেখিয়েছেন যে, পারিবারিক শান্তি রক্ষার জন্য ত্যাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ।
পাণ্ডবদের ত্যাগ
মহাভারতের কাহিনিতে দেখা যায় যে, পাণ্ডবরা রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাননি। তারা কেবল পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের এই আচরণ আমাদের শিখিয়ে দেয়, পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষার জন্য আমাদের নিজের ইচ্ছা এবং চাহিদাকে কিছুটা ত্যাগ করতে হবে।
একজন বর্তমান উদাহরণ
আমার পরিচিত একজন ব্যক্তি তার পরিবারের সম্পত্তি বিতরণে শাস্ত্রের নিয়ম মেনে চলেছেন। তিনি বলেছিলেন: “আমার বাবা-মা যা শিখিয়েছেন, তার মূল কথা হল, সব কিছু ধর্মমতে হওয়া উচিত। ফলে আমরা ভাই-বোনেরা কোনও সমস্যা ছাড়াই সমাধানে পৌঁছেছি।”
শাস্ত্র অনুযায়ী সম্পত্তি বিতরণের পদ্ধতি
মনু স্মৃতিতে সম্পত্তি বিতরণের ন্যায্য পদ্ধতি নিয়ে বলা হয়েছে:
“পুত্ররা পিতার সম্পত্তির সমান অধিকারী। কিন্তু মেয়েদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে। কারণ, তারা পরবর্তীতে তাদের নিজ নিজ পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”
এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শেখায় যে, সম্পত্তি বিতরণে ন্যায্যতা এবং করুণার মিশ্রণ থাকা উচিত।
সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ নিরসনে চারটি উপায়
- ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা:
ভগবান কৃষ্ণ বলেছেন, “অহিংসা পরম ধর্ম।” পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ভালো রাখতে অহিংস মনোভাব গ্রহণ করুন। - ত্যাগের গুণ চর্চা:
রামচন্দ্রের মতো ত্যাগের মনোভাব নিয়ে বিরোধ এড়িয়ে চলুন। - গুরুজনদের পরামর্শ:
পারিবারিক গুরুজনরা সাধারণত নিরপেক্ষ হন। তাদের নির্দেশনা মানতে চেষ্টা করুন। - যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়া:
পরিবারে সবাই মিলে একত্রে সিদ্ধান্ত নিলে সমস্যা অনেকটাই কমে যায়।
উপসংহার
আপনি যদি ধর্মের পথ ধরে এগোন, তবে আপনার জীবনে শান্তি এবং সাফল্য আসবেই। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ নিরসনে সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা হল—ধর্মের পথে চলুন এবং সম্পর্ককে সম্পদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিন।