প্রথমে একটু ভাবুন, পরিবেশ আর অর্থনীতি কি আলাদা কিছু? আমার মতে, এই দুটোর মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আপনি যদি আপনার বাড়ির চারপাশে প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, তাহলে আপনি বুঝবেন যে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অর্থনৈতিক দিক প্রকৃতির উপর কতটা নির্ভরশীল। সনাতন ধর্মে এই বিষয়ে হাজার হাজার বছর আগে থেকেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চলুন, আজ আমরা সেই শিক্ষাগুলোর গভীরে প্রবেশ করি।
পরিবেশ এবং অর্থনীতির মধ্যে সনাতন ধর্মের সম্পর্ক
আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন, “ধর্মঃ রক্ষতি রক্ষিতঃ।” এই বাক্যটি পরিবেশ সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও যথাযথ। সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা হলো, প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবন যাপন করা। বেদ এবং উপনিষদে প্রকৃতিকে দেবতা হিসেবে দেখা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
- পৃথিবীকে মাতৃরূপে পূজা: ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, “মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিব্যাঃ।” (ঋগ্বেদ ১২.১.১২)। পৃথিবী আমাদের মা, আর আমরা তার সন্তান। আমরা যদি মায়ের প্রতি অন্যায় করি, তবে তা আমাদেরই ক্ষতির কারণ হবে। পরিবেশকে রক্ষা করার মধ্যে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লুকিয়ে আছে।
- জলকে দেবতা হিসেবে পূজা: ঋগ্বেদে জলকে “আপঃ” বা দেবতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, “আপঃ সুপ্তং জাগ্রতা।” অর্থাৎ, জল আমাদের জীবনের প্রধান উৎস। আজকের দিনে জলসংকটের কারণে বহু অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আপনি যদি পানি অপচয় বন্ধ করেন, তাহলে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন।
পরিবেশ সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
সনাতন ধর্মের এই শিক্ষা কেবল তত্ত্ব নয়, এটি আমাদের জীবনের বাস্তব দিকগুলোতে প্রয়োগযোগ্য। আমি এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেব:
- গো-রক্ষার গুরুত্ব: সনাতন ধর্মে গরুকে মাতৃরূপে পূজা করা হয়। “গোব্রাহ্মণে হিতায় চ” (ভগবদ গীতা ১৮.৪৪)। আপনি যদি একটি গরুর যত্ন নেন, তাহলে তা শুধু ধর্মীয় কাজ নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও উৎস। গরুর দুধ, গোবর, এবং মূত্র পরিবেশ বান্ধব কৃষি ও ব্যবসার মূল উপাদান।
- অরণ্য সংরক্ষণ: মহাভারতে উল্লেখ আছে, “অরণ্যে তপস্যা করো, কারণ অরণ্যই শক্তির উৎস।” আপনি যদি বনভূমি রক্ষা করেন, তবে এটি কেবল পরিবেশ নয়, পর্যটন, ঔষধি গাছ এবং কাঠের মাধ্যমে অর্থনীতির জন্যও উপকারী।
- নদী সংরক্ষণ: গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর মতো নদীগুলো আমাদের ধর্মীয় জীবন এবং অর্থনীতির ভিত্তি। “নদীনাং পতয়ে নমঃ” (যজুর্বেদ)। নদী পরিষ্কার রাখলে মাছ ধরা, নৌপরিবহন, এবং সেচের সুবিধা বাড়বে।
সনাতন ধর্মের চারটি মূল শিক্ষার প্রয়োগ
- আহিংসা (অহিংসা): অহিংসা শুধুমাত্র মানুষের প্রতি নয়, প্রকৃতির প্রতিও প্রযোজ্য। আপনি যদি গাছ কাটার আগে নতুন গাছ লাগান, তাহলে তা পরিবেশ ও অর্থনীতি দুটোর জন্যই মঙ্গলজনক।
- সততা (সত্য): সততা পরিবেশ রক্ষার মূল ভিত্তি। আপনি যদি বন সংরক্ষণে সততার সাথে কাজ করেন, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে।
- অপরিগ্রহ (অতিরিক্ত ভোগের পরিহার): অতিরিক্ত সম্পদ ভোগ করার মানসিকতা ছেড়ে দিলে পরিবেশ দূষণ কমবে। এর ফলে স্বাস্থ্যবান জীবন এবং অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
- সমবায় (সবার জন্য কল্যাণ): ভগবদ গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন, “যে প্রকৃতির সেবা করে, সে প্রকৃতির থেকেই প্রতিদান পায়।” আপনি যদি সমাজের সবাইকে নিয়ে পরিবেশ রক্ষার কাজ করেন, তাহলে সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব।
আজকের দুনিয়ায় সনাতন ধর্মের পরিবেশ শিক্ষা
আপনার মনে হতে পারে, এই শিক্ষা কি আজকের যুগে প্রাসঙ্গিক? আমি বলব, এটি আগের চেয়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। আধুনিক অর্থনীতি প্রায়ই পরিবেশের ক্ষতি করে। কিন্তু আপনি যদি সনাতন ধর্মের পদ্ধতি মেনে কাজ করেন, তাহলে পরিবেশ এবং অর্থনীতি দুটোই সমৃদ্ধ হবে।
- পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ: সনাতন ধর্মের মতে, আমরা প্রকৃতির ঋণী। আপনি যদি পরিবেশবান্ধব ব্যবসা শুরু করেন, তাহলে তা আপনার জন্য লাভজনক হবে। উদাহরণস্বরূপ, সোলার এনার্জি বা জৈব চাষ।
- গণসচেতনতা বৃদ্ধি: আপনি যদি মানুষকে বোঝান যে পরিবেশ ধ্বংস মানেই অর্থনৈতিক ধ্বংস, তাহলে সবাই পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসবে।
আমাদের কর্তব্য কী?
আপনার কাছে এখন প্রশ্ন, আপনি কী করবেন? আপনি কি পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমে আপনার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবেন? সনাতন ধর্ম আমাদের দেখিয়েছে যে প্রকৃতি এবং অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক। তাই আমি আপনাকে আহ্বান জানাই, আসুন আমরা সবাই মিলে পরিবেশ এবং অর্থনীতির এই সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করি।