আমাদের আধুনিক জীবনে উন্নয়নের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু উন্নয়নের জন্য পরিবেশের ক্ষতি করলে সেই উন্নয়ন আমাদের জীবনকে আদৌ ভালো করবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা সনাতন ধর্মের দিকে তাকাতে পারি। সনাতন ধর্মের শিক্ষাগুলি কেবল আত্মিক উন্নতির কথা বলে না; এটি আমাদের জীবনযাত্রা এবং পরিবেশের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়।
প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধার শিক্ষা
সনাতন ধর্ম প্রকৃতিকে ঈশ্বরের রূপে দেখার শিক্ষা দেয়। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, “মাতা ভূমিঃ পুত্রো’হম পৃথিভ্যাঃ” – পৃথিবী আমাদের মা এবং আমরা তার সন্তান। আপনি কি কখনো ভাবতে পেরেছেন, নিজের মাকে কষ্ট দিয়ে আপনি সুখী থাকতে পারবেন? প্রকৃতির প্রতিটি অংশ – গাছপালা, নদী, পর্বত, এমনকি বাতাসও – ঈশ্বরের প্রকাশ। তাই সনাতন ধর্মের মতে, প্রকৃতির ক্ষতি করা মানেই ঈশ্বরের প্রতি অশ্রদ্ধা।
উদাহরণ:
- চিপকো আন্দোলন: সনাতন ধর্মের অনুপ্রেরণায়, হিমালয়ের গ্রামবাসীরা গাছ কেটে ফেলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁরা গাছের সঙ্গে নিজেদের বেঁধে প্রকৃতির সুরক্ষা করেছিলেন।
- বিশ্নোই সম্প্রদায়ের আত্মত্যাগ: রাজস্থানের বিশ্নোই সম্প্রদায় আজও গাছ ও প্রাণীদের রক্ষা করতে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।
পরিবেশ এবং উন্নয়ন: সমন্বয়ের পথ
আপনার কি মনে হয় যে উন্নয়নের মানেই পরিবেশের ধ্বংস? সনাতন ধর্ম বলে, উন্নয়ন এমন হতে হবে যাতে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে। গীতা বলে, “যজ্ঞার্থাত্ কর্মণো…” – প্রকৃতির জন্য কাজ করো, নিজের স্বার্থের জন্য নয়। আপনি যদি প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে উন্নয়ন করতে চান, তাহলে প্রথমে বুঝতে হবে যে প্রকৃতি এবং আমরা একে অপরের পরিপূরক।
উদাহরণ:
- জল সংরক্ষণ প্রকল্প: প্রাচীন ভারতীয়রা বাঁধ এবং জলাধার তৈরি করে জল সংরক্ষণ করতেন। রাজস্থানের ঐতিহাসিক স্টেপওয়েলস (বাওড়ি) তারই উদাহরণ।
- অর্গানিক কৃষি: প্রাচীন ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় রাসায়নিক ব্যবহার হতো না। গোমূত্র এবং জৈব সার ব্যবহারে মাটির উর্বরতা বজায় থাকত।
উন্নয়নশীল সমাজের চাহিদা পূরণে প্রকৃতির ভূমিকা
আপনার কি মনে হয় উন্নয়নশীল সমাজের চাহিদা পূরণে প্রকৃতির ভূমিকা নেই? সনাতন ধর্মের গ্রন্থগুলি আমাদের শেখায়, প্রকৃতি আমাদের যা দেয়, সেটি আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করলেই উন্নয়ন সম্ভব। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, “অন্নং বহু কুর্বীত” – যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য উৎপন্ন করো, কিন্তু অপচয় করো না।
উদাহরণ:
- গ্রামীণ উন্নয়নে প্রকৃতি: গ্রামে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা আজকের দিনে উন্নয়নের একটি পরিবেশ-বান্ধব পথ।
- বৃক্ষরোপণ আন্দোলন: মহাত্মা গান্ধী প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং সংরক্ষণের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর মতাদর্শ আজও আমাদের পথ দেখায়।
পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের ভূমিকা
আপনি এবং আমি যদি প্রকৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগী না হই, তাহলে কারা হবে? উপনিষদে বলা হয়েছে, “ইশাবাস্যমিদং সর্বং” – এই জগতে যা কিছু আছে, তা ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছাদিত। আপনি যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পৃথিবীর দিকে তাকান, তাহলে বুঝবেন যে আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব প্রকৃতিকে রক্ষা করা।
কিছু সহজ পন্থা:
- প্রতিদিন অন্তত একটি গাছ লাগানোর সংকল্প করুন।
- প্লাস্টিক ব্যবহার কমান এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিস ব্যবহার করুন।
- জল অপচয় বন্ধ করুন।
সনাতন ধর্মের উদ্ধৃতি যা আপনাকে পথ দেখাবে
- “ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ” – আপনি যদি ধর্ম রক্ষা করেন, ধর্ম আপনাকে রক্ষা করবে। এখানে ধর্ম মানে প্রকৃতি, পরিবেশ।
- “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে…” – আপনার দায়িত্ব কাজ করা, ফলের আশা নয়। পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব পালন করাই আপনার কাজ।
- “সমগ্র সৃষ্টির প্রতি করুণা” – করুণা শুধু মানুষের জন্য নয়, সমস্ত জীবজন্তুর প্রতি।
- “ত্রতীয়ং ব্রহ্মচার্যং” – সংযমের শিক্ষা। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে সংযম করুন।
উপসংহার
আপনি কি অনুভব করেন যে উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য রাখা সম্ভব? সনাতন ধর্ম আমাদের শিখিয়েছে, প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমরা উন্নয়নের পথে এগোতে পারি। উন্নয়ন এবং পরিবেশ একে অপরের শত্রু নয়; বরং তারা একে অপরের পরিপূরক। আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? আপনি কি প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ উন্নয়নের পথে হাঁটবেন? মনে রাখবেন, আপনি যদি প্রকৃতির যত্ন নেন, প্রকৃতি আপনাকে তার প্রতিদান দেবে।