আপনি এবং আমি যে পরিবেশে বাস করি, তা শুধুমাত্র আমাদের জীবনের অংশ নয়; এটি আমাদের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। সনাতন ধর্মে পরিবেশকে “প্রকৃতি” বা “প্রকৃতি দেবী” হিসেবে পূজা করা হয়। সৃষ্টির সবকিছুই ঈশ্বরের এক অংশ, এবং পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের দায়িত্ব নিয়ে সনাতন ধর্মের শিক্ষাগুলি অত্যন্ত স্পষ্ট। কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে কী সম্পর্ক থাকতে পারে? আমি বিশ্বাস করি, এই প্রশ্নটি আমাদের জীবনে গভীর তাৎপর্য বহন করে।
সনাতন ধর্মে পরিবেশের গুরুত্ব
সনাতন ধর্মে পরিবেশকে এক পবিত্র ও অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে:
“মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিভ্যাঃ” – (ঋগ্বেদ ১২.১.১২)
এই শ্লোকে পৃথিবীকে মা এবং মানবজাতিকে তার সন্তান হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এটি স্পষ্ট করে দেয় যে, আমরা যেমন আমাদের মায়ের যত্ন নিই, তেমনই পৃথিবীর প্রতিও আমাদের স্নেহ ও দায়িত্ব থাকা উচিত। পরিবেশের যত্ন নেওয়া মানে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী রেখে যাওয়া।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভূমিকা
অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণকে অনেকেই একে অপরের বিপরীত হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু সনাতন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, এই দুই বিষয়ে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করি, তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ একসঙ্গে সম্ভব।
“যদ ভূতানাং পৃথকত্বমেকস্থং তনুপশ্যতি।” – (ভগবদ্গীতা ১৩.২৭)
এই শ্লোকের অর্থ হলো, যারা সমস্ত জীবের মধ্যে ঐক্য দেখতে পায়, তারা প্রকৃত জ্ঞানী। অর্থাৎ, সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায় যে পরিবেশ এবং মানবজাতি একে অপরের পরিপূরক। তাই আমাদের উন্নয়নের প্রতিটি পদক্ষেপ পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হতে হবে।
বাস্তব উদাহরণ
- সৌর শক্তি ব্যবহার: আপনি কি জানেন, ভারতের মতো দেশে সৌর শক্তির ব্যবহার পরিবেশের উপর চাপ কমাতে সহায়ক হয়েছে? উদাহরণস্বরূপ, গুজরাটের সূর্যশক্তি প্রকল্প সনাতন ধর্মের “পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধা” ধারণার একটি উদাহরণ। এটি শুধু পরিবেশ সংরক্ষণই নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও নিশ্চিত করেছে।
- জৈব চাষাবাদ: সনাতন ধর্মের মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জৈব চাষাবাদ পরিবেশের ক্ষতি না করে খাদ্য উৎপাদনের একটি টেকসই উপায় প্রদান করে। ঋগ্বেদের শ্লোক বলে:
“অন্নং বহু কুর্বীতা।” – খাদ্যের গুরুত্ব এখানে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এই খাদ্য উৎপাদনের পদ্ধতিও হতে হবে পরিবেশ-বান্ধব।
- গঙ্গা নদীর পুনরুদ্ধার: “নমামি গঙ্গে” প্রকল্প, যেখানে গঙ্গা নদীর পবিত্রতা রক্ষা করা হয়েছে, সেটি সনাতন ধর্মের পরিবেশ-সংরক্ষণমূলক চেতনার উদাহরণ। এটি শুধু নদীর পরিবেশগত ভারসাম্যই রক্ষা করেনি, বরং স্থানীয়দের জীবিকা উন্নত করেছে।
সনাতন ধর্মের নির্দেশনা
সনাতন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের কর্তব্য স্পষ্ট করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মনুসংহিতায় বলা হয়েছে:
“দশ কূপসমা বাঁধি, দশ বাঁধি সমা হ্রদ। দশ হ্রদসমা পুত্র, দশ পুত্রসমো বৃক্ষ।”
এখানে একটি গাছ লাগানোর গুরুত্বকে দশ সন্তানের সমতুল্য বলা হয়েছে। এটি বোঝায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সময় আমাদের উচিত গাছ লাগানো এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা।
আমাদের ভূমিকা
আমি বিশ্বাস করি, আপনি এবং আমি মিলে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য অনেক কিছু করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ:
- পরিবেশ-বান্ধব পণ্য ব্যবহার করা: প্লাস্টিকের পরিবর্তে জৈবপণ্য ব্যবহারে আপনি পরিবেশের ওপর চাপ কমাতে পারেন।
- নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসে বিনিয়োগ করা: আপনার ছোট ছোট পদক্ষেপও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের ভারসাম্য তৈরি করতে পারে।
- সচেতনতা ছড়ানো: আপনার পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে সনাতন ধর্মের পরিবেশ-সংরক্ষণমূলক চেতনার কথা ভাগ করে নিতে পারেন।
উপসংহার
পরিবেশ সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে পরস্পর-বিরোধী হিসেবে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সনাতন ধর্ম আমাদের শিখিয়েছে যে, প্রকৃতি ও মানবজীবনের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করাই আমাদের প্রকৃত দায়িত্ব। আপনি যদি সনাতন ধর্মের শিক্ষাগুলি গভীরভাবে বোঝেন, তবে দেখবেন যে পরিবেশ সংরক্ষণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা কতটা অপরিহার্য।