আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, কেন আমাদের প্রাচীন গ্রন্থে গঙ্গা ও যমুনার মতো নদীগুলোকে দেবী বলে পূজা করা হয়? আধুনিক যুগে এই প্রশ্ন অনেকের মনেই আসে। কিন্তু যদি আমরা একবার সনাতন ধর্মের গভীরে ডুব দিই, তবে স্পষ্ট হবে যে এই নদীগুলো শুধু জলধারা নয়, বরং জীবনের প্রবাহ। আজকের এই আলোচনায় আমি আপনাকে গঙ্গা ও যমুনার মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানাবো।
১. নদী মানেই জীবন—গঙ্গা ও যমুনার মহিমা
আমরা জানি, নদী ছাড়া জীবন অসম্ভব। সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে:
“আপো অতঃ প্রযন্ত প্রাপ্তঃ”
অর্থাৎ জলই জীবনের মূল। আর এই জীবনের উৎস হিসেবে গঙ্গা ও যমুনা আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। গঙ্গা ও যমুনা শুধু দুটি নদী নয়, এগুলো আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনেরও প্রতীক। গঙ্গাকে বলা হয় পবিত্রতার প্রতীক, আর যমুনা হলো প্রেম ও ভক্তির প্রতিচ্ছবি।
২. গঙ্গা: পবিত্রতার প্রতীক
গঙ্গা নদীকে বলা হয় “গঙ্গা মাইয়া”। মহাভারত এবং রামায়ণে গঙ্গার পবিত্রতার বর্ণনা আছে।
কথিত আছে, গঙ্গা স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন রাজা ভগীরথের তপস্যার ফলে। ভগীরথের পূর্বপুরুষদের মুক্তি দিতে গঙ্গার পবিত্র জল দরকার ছিল। এই কাহিনী আজও আমাদের শেখায় যে গঙ্গার জল শুধু শারীরিক নয়, আধ্যাত্মিক শুদ্ধিকরণেরও মাধ্যম।
“গঙ্গা গঙ্গা ইতি ব্রুয়ান্নরো মুচ্যেত পাপতঃ”
অর্থাৎ, শুধু গঙ্গার নাম উচ্চারণেই পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই তো সনাতন ধর্মে মৃত্যুর পর গঙ্গার জলে স্নান করানো হয় এবং সেই জল অর্ঘ্য দেওয়া হয়।
একটি বাস্তব উদাহরণ দিন যদি চাই: কাশী বা বারাণসীর ঘাটে গঙ্গার তীরে যেসব মানুষ জীবন শেষ করার অপেক্ষায় থাকেন, তাদের বিশ্বাস যে গঙ্গা মা তাদের পাপ মুক্তি দেবেন এবং মুক্তির পথ প্রশস্ত করবেন।
৩. যমুনা: প্রেম ও ভক্তির প্রতীক
যমুনা নদীর সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের গভীরতম সম্পর্ক রয়েছে। যমুনার তীরে শ্রীকৃষ্ণের লীলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বৃন্দাবনে যমুনার তীরে গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের রাসলীলা আজও প্রেম ও ভক্তির চিরন্তন উদাহরণ।
ভক্তরা বলেন, যমুনা নদীর জল কৃষ্ণের স্পর্শে পবিত্র। তাই তো আমরা যমুনাকে শুধু একটি নদী নয়, দেবী রূপে দেখি। একবার শুনেছিলাম এক প্রবীণ সাধুর কথা, তিনি বলেছিলেন—
“যমুনা নদী কৃষ্ণের প্রিয়তমা, যমুনা তীরে দাঁড়ালে মনে হয় কৃষ্ণ যেন ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।”
“কালিন্দী যমুনা তীরে, কৃষ্ণ রাধার লীলা অনন্ত।”
যমুনার আরেক নাম কালিন্দী। এই নদী প্রেম, স্নেহ এবং সেবা-ভক্তির প্রতীক। আর এখানেই যমুনার মাহাত্ম্য।
৪. প্রাকৃতিক উপহার ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
গঙ্গা ও যমুনার জল কেবল পবিত্র নয়, এটি প্রাণদায়ীও। হাজার হাজার বছর ধরে এই দুই নদী ভারতবর্ষের কৃষিকাজ, পানীয় জল এবং সভ্যতার বিকাশে সাহায্য করেছে।
কিন্তু আমরা কি এই নদীর সম্মান রাখতে পারছি? মনে রাখবেন, গঙ্গা ও যমুনা দেবী শুধু আমাদের আধ্যাত্মিক মা নন, প্রাকৃতিক মাও। যদি আমরা তাদের রক্ষা না করি, তবে জীবনের প্রবাহও বন্ধ হয়ে যাবে।
শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় বলা হয়েছে—
“যত প্রকৃতিকে সম্মান করবে, ততই ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাবে।”
তাই গঙ্গা ও যমুনাকে পূজা করা মানে প্রকৃতিকে সম্মান করা। এই শিক্ষাই আমাদের সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি।
৫. আজকের জীবনে গঙ্গা ও যমুনার শিক্ষা
আপনি কি কখনও গঙ্গা নদীর ধারে বসে গভীরভাবে ভাবার চেষ্টা করেছেন? গঙ্গা আমাদের শেখায়, জীবন যেন অবিরাম প্রবাহিত হয়। ছোট-বড় বাধা এলে তা দূরে সরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
যমুনা আমাদের প্রেম ও ভক্তির বার্তা দেয়। মানুষের জীবনে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি থাকলে কোনো বিপদই আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।
একবার ভাবুন, আজ যদি আমরা গঙ্গা ও যমুনার মতো পবিত্র আর কল্যাণময় হতে পারি, তবে জীবনে আর কোনো দুঃখ থাকে কি? আমাদের চিন্তা ও কর্ম গঙ্গার জলের মতো স্বচ্ছ হোক, আর মন হোক যমুনার মতো প্রেমময়।
শেষ কথা: গঙ্গা ও যমুনাকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব
গঙ্গা ও যমুনা শুধু নদী নন, তারা আমাদের মা। আমাদের সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে:
“মাতৃ দেবো ভবঃ।”
মায়ের পূজা করা মানে নিজের জীবনকে পূজিত করা। কিন্তু আজকের যুগে আমরা কী করছি? নদী দূষণ, প্লাস্টিক ফেলানো, এবং গঙ্গা-যমুনার অবহেলা করে আমরা কি নিজেদের জীবন ধ্বংস করছি না?
আপনাকে আমি একটাই প্রশ্ন করব—
“আপনি কি গঙ্গা ও যমুনার জন্য কিছু করতে প্রস্তুত? নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে এই দুই দেবীকে সেবার সংকল্প গ্রহণ করবেন তো?”
গঙ্গা ও যমুনা আমাদের সনাতন ধর্মের হৃদয়। তাদের রক্ষা করা মানে নিজের ধর্ম ও জীবনকে রক্ষা করা।