জীবনে কর্ম এবং অর্থনৈতিক সাফল্যের গুরুত্ব আমরা সকলেই বুঝি। কিন্তু প্রাচীন সনাতন ধর্মের দর্শন কি এই বিষয়ে কিছু বলে? চলুন আজ আমরা এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করি এবং বুঝি কীভাবে সনাতন ধর্মের শিক্ষাগুলি আমাদের কর্মজীবন ও অর্থনৈতিক সাফল্যের সঙ্গে জড়িত।
কর্ম: সাফল্যের ভিত্তি
সনাতন ধর্মের মূলমন্ত্র হলো “কর্ম”। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মাফলেষু কদাচন।” – (ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ৪৭)
এই শ্লোকটি আমাদের শেখায় যে, আমাদের শুধুমাত্র কর্মে অধিকার আছে, কিন্তু তার ফলাফল নিয়ে নয়। যখন আমরা কর্ম করি, তখন মনোযোগ ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা উচিত, কিন্তু সেই কাজের ফল কী হবে তা ভেবে চিন্তিত হওয়া উচিত নয়।
আমাদের আধুনিক জীবনে এটি কতটা প্রাসঙ্গিক? ধরুন, আপনি একটি নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন। আপনি যদি শুধু মুনাফা নিয়ে চিন্তিত হন, তবে কাজের মান নষ্ট হতে পারে। কিন্তু যদি আপনি কর্মের প্রতি নিষ্ঠা রাখেন, তাহলে সাফল্য নিজেই আসবে।
সনাতন ধর্মে অর্থনৈতিক সাফল্যের ধারণা
সনাতন ধর্মে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক সাফল্য অর্জনের জন্য সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিশ্রম অপরিহার্য। “অর্থ” হিন্দু দর্শনের চার পুরুষার্থের (ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) একটি।
“ধর্মাদর্থশ্চ কামশ্চ মোক্ষশ্চ ইতি চতুঃ।”
এই চতুর্থ পুরুষার্থগুলির মধ্যে “অর্থ” আমাদের জীবনে ভারসাম্য আনার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একদিকে কর্ম যদি আমাদের জীবনধারণের মূল চালিকা শক্তি হয়, তবে অর্থ সেই শক্তিকে সমর্থন করার জন্য অপরিহার্য।
কর্মফল ও সাফল্যের গল্প
- ধনরাজের কাহিনী: ধনরাজ ছিলেন এক নিরীহ কৃষক। তিনি ছোট একটি জমিতে কাজ করতেন। প্রতিদিন সকালে উঠে তিনি মন দিয়ে নিজের কাজ করতেন। কোনোদিন ফলের চিন্তা করেননি, শুধু তার দায়িত্ব পালন করেছেন। কয়েক বছর পরে তার কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ জমিতে ফসল দ্বিগুণ হতে শুরু করে।
- তুলসীদাসের উপদেশ: তুলসীদাসজি বলেছিলেন:
“কাহু জন্য কর ন কারজ ভলু, না অন্যায় অর্থার্জন।”
তুলসীদাসজি আমাদের শিখিয়েছেন যে, ন্যায়সঙ্গত উপায়ে উপার্জন করা উচিত। অন্যায় উপায়ে উপার্জন করলে তা কখনোই স্থায়ী হয় না।
- মহাভারতে বিদুরের উপদেশ: বিদুর মহাভারতে বলেছেন, “যে ব্যক্তি পরিশ্রম করে এবং তার লক্ষ্য ঠিক রাখে, সে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে পারে।” এই উপদেশ আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
কর্ম ও অর্থের মধ্যকার ভারসাম্য
সনাতন ধর্মের মতে, কর্ম এবং অর্থের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। শুধুমাত্র অর্থের পিছনে ছোটার পরিবর্তে, আমাদের উচিত এমন কর্ম করা যা সমাজ এবং নিজের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ:
- একজন চিকিৎসক যদি শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করেন, তবে তার রোগীরা প্রকৃত চিকিৎসা পাবে না। কিন্তু যদি তিনি তার কর্মকে মানবসেবার একটি মাধ্যম হিসেবে দেখেন, তবে তিনি অর্থনৈতিক সাফল্যের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক তৃপ্তিও অর্জন করবেন।
সনাতন ধর্মের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি
“অদৃষ্টং প্রাপ্তি ভবতি, যৎ কর্মঃ তৎ ফলং।”
- অর্থাৎ, আমাদের কর্মের ফলই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।
“ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ।”
- অর্থাৎ, যারা ধর্ম মেনে চলে, তাদের সাফল্য রক্ষা পায়।
“উদ্যমেন হি সিদ্ধ্যন্তি কার্যাণি ন মনোরথৈঃ।”
- কর্ম ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়।
আপনি কীভাবে এগোতে পারেন?
আপনার যদি কর্ম ও অর্থনৈতিক সাফল্যের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হয়, তাহলে প্রথমে নিজেকে প্রশ্ন করুন:
- আপনার কাজের উদ্দেশ্য কী?
- আপনি কি শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন করতে চান, নাকি আপনার কর্মে সমাজে পরিবর্তন আনতে চান?
- আপনার কাজ কি ধর্মের নীতি অনুযায়ী?
- আপনার উপার্জনের পদ্ধতি ন্যায়সঙ্গত ও সৎ হওয়া উচিত।
- কর্মফল নিয়ে চিন্তিত না হয়ে কি আপনি আপনার কাজে মনোযোগ দিচ্ছেন?
- যদি না দেন, তবে আজ থেকেই শুরু করুন।
শেষ কথা
সনাতন ধর্ম আমাদের শিখিয়েছে, সাফল্য তখনই আসে যখন আমরা কর্মে নিষ্ঠা রাখি এবং অর্থকে জীবনের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখি, লক্ষ্য নয়।
“অর্থ ছাড়া ধর্ম পালন সম্ভব নয়, কিন্তু ধর্ম ছাড়া অর্থ অর্থহীন।”
আপনার কি মনে হয়, আমরা যদি কর্ম এবং অর্থনৈতিক সাফল্যের মধ্যে এই ভারসাম্য আনতে পারি, তবে জীবন আরও সমৃদ্ধ হবে?