আপনি কখনো ভেবে দেখেছেন, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মীয় নৈতিকতার কী সম্পর্ক? আমি জানি, আমাদের অনেকের মনেই এই প্রশ্ন আসে। আসলে ধর্ম এবং নৈতিকতা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের মূল ভিত্তি, আর রাজনীতি তো মানুষের সমাজ গঠনের একটি প্রক্রিয়া। এই দুইয়ের মধ্যে গভীর যোগসূত্র রয়েছে।
ধর্মীয় নৈতিকতা: মানব জীবনের ভিত্তি
আমাদের সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, “ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ।” অর্থাৎ, যারা ধর্মকে রক্ষা করেন, ধর্ম তাদের রক্ষা করে। এই শিক্ষা শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
রাজনীতিতে যখন নৈতিকতা থাকে, তখন সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আর নৈতিকতা যদি ধর্মীয় আদর্শের ওপর ভিত্তি করে হয়, তাহলে সেই শাসনব্যবস্থা হয় স্থিতিশীল ও কল্যাণমুখী। যেমন, ভগবদ গীতায় (২.৪৭) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
এই শ্লোকটি আমাদের শেখায় নিজের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে, কিন্তু ফলাফলের প্রতি আসক্ত না হতে। রাজনীতিবিদদের জন্য এই শিক্ষা খুবই প্রাসঙ্গিক। তারা যদি জনকল্যাণের জন্য কাজ করেন, ব্যক্তিগত লাভের কথা চিন্তা না করেন, তাহলে সমাজে প্রকৃত উন্নতি ঘটতে পারে।
ধর্মীয় নৈতিকতার রাজনীতিতে ব্যবহার
আমরা ইতিহাসে বহু উদাহরণ পাই, যেখানে ধর্মীয় নৈতিকতা রাজনীতিতে এক বিরাট প্রভাব ফেলেছে।
রাজা হরিশচন্দ্র
রাজা হরিশচন্দ্র, যিনি সত্যের জন্য নিজের রাজ্য, পরিবার, এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর নৈতিকতা আজও আমাদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। রাজনীতিতে যদি এমন সত্যনিষ্ঠা প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে দুর্নীতি এবং অসততা দূর করা সম্ভব।
মহাত্মা গান্ধী
গান্ধীজির “সত্য ও অহিংসা”র নীতি সনাতন ধর্মের মূল আদর্শ থেকে উৎসারিত। এই নীতি শুধু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেই নয়, গোটা বিশ্বের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। গান্ধীজির শিক্ষা আমাদের বলে, রাজনীতি শুধুমাত্র ক্ষমতার লড়াই নয়; এটি মানবতার সেবা করার একটি মাধ্যম।
রামরাজ্য
রামায়ণে শ্রীরামের শাসনব্যবস্থাকে বলা হয় রামরাজ্য। এই রামরাজ্য ছিল এক ন্যায়, সত্য, এবং ধর্মের আদর্শ রাজ্য। আজকের দিনে আমরা যদি রাজনীতিতে এই আদর্শ প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
ধর্মীয় নৈতিকতার অভাবের কুফল
যখন রাজনীতি থেকে নৈতিকতা দূরে সরে যায়, তখন কী ঘটে? আমরা দেখেছি দুর্নীতি, হিংসা, এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। যেমন, মহাভারতে কৌরবরা ধর্মের পথ থেকে সরে গিয়ে কী পরিণতি ভোগ করেছিল। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনাটি কেবল তাদের ক্ষমতার লোভকেই প্রকাশ করেনি, এটি এক বিরাট যুদ্ধের কারণ হয়েছিল।
শ্রীকৃষ্ণ সেই সময় পান্ডবদের পক্ষ নিয়ে বলেন:
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।”
যখনই ধর্ম বিপন্ন হয়, তখনই ভগবান নিজে অবতীর্ণ হন ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য। রাজনীতিতেও যখন নৈতিকতার অবনতি ঘটে, তখন সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
ধর্মীয় নৈতিকতা কীভাবে প্রয়োগ করা যায়?
আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, “রাজনীতিতে ধর্মীয় নৈতিকতা কীভাবে আনা সম্ভব?” আসলে, এটি ব্যক্তিগত এবং সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে সম্ভব।
- নৈতিক শিক্ষার প্রসার: স্কুল-কলেজে নৈতিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি রাজনীতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক মূল্যবোধে বলিয়ান করতে পারে।
- ধর্মীয় গ্রন্থের পাঠ: রাজনীতিবিদদের জন্য ধর্মীয় গ্রন্থ, যেমন গীতা, রামায়ণ, মহাভারতের শিক্ষা অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। এগুলো শুধু ধর্ম নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
- জনসাধারণের জাগরণ: জনগণ যদি সচেতন হয় এবং নৈতিকতাকে মূল্য দেয়, তাহলে তারাও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের প্রত্যাখ্যান করবে। এটি একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করবে।
- সততার সংস্কৃতি: সমাজে এবং রাজনীতিতে সততার চর্চা চালু করতে হবে। এই সততা কেবল ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসেব নয়; এটি সমষ্টিগত কল্যাণের জন্য প্রয়োজন।
একটি প্রাসঙ্গিক গল্প
একবার এক রাজা এক সাধুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কীভাবে ন্যায়ের পথে রাজ্য পরিচালনা করব?” সাধু উত্তরে বললেন, “তুমি যদি তোমার প্রতিটি কাজে ধর্ম ও ন্যায় বজায় রাখো, তবে তোমার রাজ্য হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজ্য।” রাজার এই শিক্ষার ফলে তাঁর রাজ্যে শোষণ, দুর্নীতি দূর হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
উপসংহার
আপনারও কি মনে হয় না যে রাজনীতিতে ধর্মীয় নৈতিকতার জাগরণ দরকার? সমাজে শান্তি ও উন্নতির জন্য এই নৈতিকতা অপরিহার্য। রাজনীতিবিদদের উচিত নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনসেবায় ব্রতী হওয়া।