সনাতন ধর্মে সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে ধারণা কী?

আমরা যারা সনাতন ধর্মের নীতিমালা অনুযায়ী জীবনযাপন করতে চাই, তারা জানি যে, এই ধর্ম শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতায় নয়, বরং জীবনের প্রতিটি দিককে আলোকিত করে। সম্পত্তির মালিকানা এবং তার ব্যবস্থাপনাও এর অন্তর্ভুক্ত। আজ আমি আপনাকে সনাতন ধর্মের আলোকে সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে কিছু গভীর ধারণা এবং নির্দেশিকা দিতে চাই।

সম্পত্তি এবং সনাতন ধর্মের মূল দর্শন

সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি হল “ধর্ম”, “অর্থ”, “কাম” এবং “মোক্ষ” – জীবনের এই চারটি লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে। অর্থ এখানে সম্পদকে নির্দেশ করে, যা জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু সনাতন ধর্মে অর্থ বা সম্পত্তির মালিকানা কেবল ভোগের জন্য নয়, বরং দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

“অথর্ব বেদ”-এ বলা হয়েছে:

“সঙ্গচ্ছধ্বং সং বধ্বং সং ভো মনাংশি জানতাম।”

অর্থাৎ, একসঙ্গে চল, একসঙ্গে কাজ কর, এবং একে অপরের চিন্তাধারাকে জানার চেষ্টা কর। এই উক্তি আমাদের শেখায় যে, সম্পদ ভাগাভাগি করা ও সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

সম্পত্তির প্রকৃতি: ব্যক্তিগত বনাম সামষ্টিক

সনাতন ধর্মে ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক সম্পত্তির মধ্যে একটি সুন্দর ভারসাম্য বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, “ইশাবাস্য উপনিষদ” আমাদের শিক্ষা দেয়:

“ইশাবাস্যমিদং সর্বং, যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত।”

অর্থাৎ, এই বিশ্বে যা কিছু রয়েছে, তা ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত। এটি বোঝায় যে, আসলে কেউই সম্পত্তির একক মালিক নয়; আমরা কেবল তার তত্ত্বাবধায়ক। আপনার বাড়ি, জমি, বা ধনসম্পদ সবই সাময়িক। এগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করার দায়িত্ব আপনার।

উদাহরণ এবং শিক্ষা

  •  রাজা হরিশচন্দ্রের গল্প: রাজা হরিশচন্দ্র তার রাজত্ব এবং সমস্ত সম্পদ ত্যাগ করেছিলেন সত্য ও ধর্মের পথে চলার জন্য। তার জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সম্পত্তির প্রকৃত মালিকানা আমাদের সততা ও নীতির উপর নির্ভর করে।
  •  মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডব: পাণ্ডবদের সম্পত্তি নিয়ে কৌরবদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা দেখিয়েছে যে ন্যায় ও ধর্মের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকা উচিত। “অধর্মে সম্পত্তি লাভ করলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না” – এই শিক্ষা এখান থেকে আমরা পাই।
  •  ভারতীয় গ্রামীণ সংস্কৃতি: আমাদের গ্রামীণ সমাজে যুগ যুগ ধরে জমি ও সম্পত্তি ভাগাভাগি করে ব্যবহার করার রীতি চলে আসছে। এটি ব্যক্তিগত লাভের চেয়ে সমাজের কল্যাণকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার নিয়ম

সনাতন ধর্মের গ্রন্থগুলোতে সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে:

  •  ধন উপার্জন: “শত হস্ত সমাহার, সহস্র হস্ত সংকীর” – অর্থাৎ, একশ হাতে উপার্জন কর, কিন্তু হাজার হাতে দান কর। অর্থ উপার্জন অবশ্যই সৎ উপায়ে হওয়া উচিত।
  •  দানের গুরুত্ব: গীতা বলে:

“যদচ্ছসী তদনন্ত্যং ভক্ষয়” – অর্থাৎ, দান এমনভাবে কর যাতে তা গ্রহণকারী উপকৃত হয়। দান কেবল সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে না, এটি আপনাকে মোক্ষের পথে এগিয়ে নেয়।

  •  পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব: “গৃহস্থ আশ্রম”-এর মূল দর্শন হল পরিবারের সুখ এবং সমাজের কল্যাণ নিশ্চিত করা। আপনি যা উপার্জন করবেন, তা আপনার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ছেড়ে যেতে হবে, কিন্তু সঠিক নীতির মাধ্যমে।

পরিবেশ ও সম্পত্তির যোগসূত্র

বর্তমান যুগে পরিবেশের সঙ্গে সম্পত্তির যোগসূত্র আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। “ঋগ্বেদ”-এ বলা হয়েছে:

“মাতা ভূমি: পুত্রো অহং পৃথ্বী” – অর্থাৎ, পৃথিবী আমাদের মা এবং আমরা তার সন্তান। সম্পত্তি ব্যবহারের সময় আমাদের পরিবেশ রক্ষার কথা মনে রাখতে হবে। জমি, পানি, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ শুধুমাত্র ভোগের জন্য নয়; এগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ আমাদের দায়িত্ব।

আধুনিক জীবনে প্রাসঙ্গিকতা

আমাদের ব্যস্ত জীবনে কখনো কখনো আমরা ভুলে যাই যে, সম্পত্তি আমাদের জীবনের একটি মাধ্যম, উদ্দেশ্য নয়। সনাতন ধর্মের নীতিগুলো আপনাকে মনে করিয়ে দেয় যে, সম্পত্তি পরিচালনা করার সময় সততা, দানশীলতা, এবং দায়িত্ববোধ থাকা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি জমি কিনেন, তবে তা শুধু নিজের লাভের জন্য নয়, বরং পরিবেশ ও সমাজের উপকারে ব্যবহার করবেন।

শেষ কথা

সনাতন ধর্মের আলোকে সম্পত্তির মালিকানা একটি মহান দায়িত্ব। আপনি যদি নিজের সম্পত্তিকে ঈশ্বরের দান হিসেবে বিবেচনা করেন, তবে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা আপনার কর্তব্য। গীতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়:

“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”

অর্থাৎ, আপনার কর্তব্য হল কাজ করে যাওয়া, কিন্তু তার ফলের প্রতি আসক্ত না হওয়া।

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আপনার সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আপনি কতটা সনাতন ধর্মের নীতির সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছেন? আপনার সম্পত্তি কি সত্যি সমাজ ও পরিবেশের উপকারে আসছে? আপনার এই ভাবনা হয়তো আপনাকে একটি নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top