আপনার জীবনে কখনও কি ভেবেছেন, সম্পদ কীভাবে ন্যায়সঙ্গতভাবে ভাগ করা উচিত? আমরা সকলেই জানি, সম্পদ সঠিকভাবে বণ্টন না হলে সমাজে বৈষম্য বাড়ে। সনাতন ধর্ম, যা আমাদের প্রাচীন দর্শনের এক সমৃদ্ধ উৎস, এই বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে। এখানে আমরা আলোচনা করব কীভাবে সনাতন ধর্মের মূল্যবোধ অনুযায়ী সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন করা যায় এবং এটি আপনার জীবনে কীভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
সনাতন ধর্মের দৃষ্টিতে সম্পদ
সনাতন ধর্মের অন্যতম মূল নীতিই হলো “ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ”। অর্থ, অর্থাৎ সম্পদ, জীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু এই সম্পদ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়, সমাজের কল্যাণেও ব্যবহৃত হওয়া উচিত। ঋগ্বেদ (১০.১১৭.৫) বলে:
“যে ব্যক্তি নিজের উপার্জিত সম্পদ শুধুমাত্র নিজের জন্য ব্যয় করে, সে ভুল পথে চলেছে।”
এই বাক্য আমাদের শেখায়, সম্পদ ভাগ করার মাধ্যমে মানবতা সেবা করাই প্রকৃত ধর্ম।
সম্পদের বণ্টন: উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত
১. কৃষকের উদাহরণ
আমরা জানি, কৃষক জমিতে পরিশ্রম করেন এবং তার উৎপাদিত শস্য সকলের মধ্যে বণ্টিত হয়। কিন্তু যদি শস্য শুধুমাত্র ধনী ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি হয় এবং গরিবরা বঞ্চিত থাকে, তাহলে সমাজে অসমতা বৃদ্ধি পাবে। সনাতন ধর্মে কৃষি ও শস্যের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে:
“সম্ভাগঃ সমানাং কুরুতে।”
অর্থাৎ, সবাই যেন শস্যের ন্যায়সঙ্গত ভাগ পায়। আপনি যদি একটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হন, তাহলে এই নীতিটি অনুসরণ করে আপনার গ্রাহকদের ন্যায্যমূল্যে পণ্য দিতে পারেন।
২. রাজা ও দানশীলতা
আমরা মহারাজা অশোক এবং রাজা হরিশচন্দ্রের গল্প পড়েছি। তারা তাদের প্রজাদের জন্য সম্পদ দান করেছেন। সনাতন ধর্ম রাজাকে সমাজের ‘তরণী’ বলে মনে করে। মনুস্মৃতি (৮.৩০৮) বলে:
“রাজা যদি সঠিকভাবে সম্পদের বণ্টন করেন, তবে সে সমাজ শান্তিতে পূর্ণ হয়।”
৩. ব্যবসায়ী ও সদগুণ
একজন সৎ ব্যবসায়ীর কাছে গ্রাহক ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব থাকা উচিত। যিনি ন্যায্য মূল্য গ্রহণ করেন এবং মুনাফার একটি অংশ দান করেন, তিনি প্রকৃত ধর্ম পালন করেন। গীতা (১৭.২০) বলেছে:
“যে দান ধর্মমতে, সঠিক সময়ে এবং সঠিক ব্যক্তিকে করা হয়, তা সর্বোৎকৃষ্ট।”
সম্পদ ভাগ করার অন্তর্নিহিত দর্শন
সনাতন ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে সম্পদ ঈশ্বরের দান। তাই এটি কেবল ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, বরং সবার কল্যাণে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। যেমন ঋগ্বেদ (১.১৬৪.৪৬) বলে:
“সত্য ও সঠিক পথে চলা, যেখানে সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি হয়।”
আপনি যখন সম্পদ ভাগ করেন, তখন আপনি শুধু অন্যকে সাহায্য করছেন না, নিজের পুণ্যও বৃদ্ধি করছেন।
সামাজিক সেবা ও দান
দান, যা সনাতন ধর্মে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, কেবল আর্থিক সাহায্য নয়, সময় ও দক্ষতার সাহায্যও হতে পারে। তৈত্তিরীয় উপনিষদ বলে:
“দানমেব পুণ্যায়।”
যেখানে দান করা হয়, সেখানেই কল্যাণ। এটি আপনার জন্যও প্রযোজ্য। আপনি যদি ছাত্র হন, তাহলে আপনার সময় ভাগ করে অন্যদের পড়াশোনা শেখাতে পারেন। যদি পেশাজীবী হন, তবে আপনার উপার্জনের একটি অংশ দান করতে পারেন।
আপনার জীবনে ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের প্রভাব
আপনি যদি ন্যায্য বণ্টনের নীতি মেনে চলেন, তাহলে আপনার জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে। আপনি নিজের বিবেকের কাছে সৎ থাকতে পারবেন এবং একটি উদাহরণ স্থাপন করতে পারবেন। সমাজের কল্যাণে অবদান রাখা মানেই ঈশ্বরের সেবা করা।
আমার ভাবনা:
আমরা প্রতিদিন নানা ক্ষেত্রে সম্পদ ও সুযোগের অসম বণ্টনের উদাহরণ দেখি। আপনি কি কখনও ভেবেছেন, আপনার চারপাশের বিশ্বটি যদি ন্যায়সঙ্গতভাবে সম্পদ বণ্টন করে, তবে কেমন হতো? সনাতন ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে “ধর্মই সম্পদের প্রকৃত রক্ষক”। তাই চলুন, আমরা সবাই একসঙ্গে এই নীতি মেনে চলি এবং সমাজের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা গড়ে তুলি।