সনাতন ধর্মে দান করার গুরুত্ব কী?

সনাতন ধর্মের মূল মন্ত্র হল ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’, অর্থাৎ ত্যাগের মাধ্যমে জীবনের প্রকৃত সুখ অর্জন করা যায়। দান সেই ত্যাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা কেবলমাত্র আপনার নিজের নয়, সমাজেরও উন্নতির পথ উন্মুক্ত করে। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার ঠাকুমা আমাকে বলতেন, “দান করলে ঈশ্বর খুশি হন এবং আপনার পুণ্যের ভান্ডার পূর্ণ হয়।” আজকের এই আলোচনায়, আমি আপনাকে সনাতন ধর্মে দানের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাতে চাই, যাতে আপনি নিজেও এই মহৎ কাজে এগিয়ে আসেন।

দান কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সনাতন ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, আমরা যা কিছু অর্জন করি, তার সবটাই ঈশ্বরের দান। সুতরাং, সেই প্রাপ্তির একাংশকে দান করা আমাদের কর্তব্য। শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতায় (১৭.২০) বলা হয়েছে:

“দাতব্যং ইতি যৎ দানং, দীয়তে অনুপকারিণে। দেশে কালে চ পাত্রে চ, তৎ দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতং।”

অর্থাৎ, সঠিক ব্যক্তি, সময় এবং স্থানে, নির্লোভ মনে যে দান করা হয়, সেটাই সত্যিকারের দান। দানের মাধ্যমে আমরা আমাদের হৃদয়কে প্রসারিত করি এবং আমাদের মধ্যে থাকা অহংবোধ কমাতে সাহায্য করি।

প্রাচীন উদাহরণ থেকে শিক্ষা

দান করার গুরুত্ব বোঝাতে সনাতন ধর্মে অনেক গল্প ও উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। এখানে কয়েকটি:

  • কর্ণের মহাদান: মহাভারতের কর্ণ ছিলেন দানের প্রতীক। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে কর্ণ তার নিজের দেহের সোনার দাঁতও দান করেছিলেন, যা তার মহানুভবতার প্রমাণ।
  • রাজা হরিশচন্দ্র: সততা ও ত্যাগের প্রতীক রাজা হরিশচন্দ্র তার সাম্রাজ্য এবং সম্পত্তি দান করে, এমনকি নিজের পরিবারকে ত্যাগ করেছিলেন সত্যের জন্য।
  • সুধামার দান: কৃষ্ণভক্ত সুধামা, নিজে দরিদ্র থাকা সত্ত্বেও, ভগবান কৃষ্ণকে তার কাছে থাকা সামান্য পরিমাণ চাল দান করেছিলেন। এর ফলে কৃষ্ণ তার জীবনের সমস্ত দারিদ্র দূর করেছিলেন।

এগুলির প্রতিটি উদাহরণ আমাদের শেখায়, দান করা মানে শুধু বস্তুগত কিছু দেওয়া নয়; এটি এক আত্মিক অভিজ্ঞতা।

আপনার জীবনে দানের প্রভাব

আপনি যদি দান করেন, তাহলে আপনার জীবনে কেমন পরিবর্তন আসবে? আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি, যখনই আমি কারো জন্য কিছু করেছি, আমার অন্তরে একধরনের শান্তি অনুভব করেছি। এটি ঠিক সেই অনুভূতি, যা উপনিষদে বর্ণিত হয়েছে:

“তৈক্ত উপনিষদ (১.১১) বলছে, ‘দানে, জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।’”

দান শুধু একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা নয়, এটি একধরনের যোগ। আপনি যখন দান করেন, তখন আপনি নিজের ইগো এবং লোভকে ত্যাগ করেন। এটি আপনাকে আরও বড় মনের মানুষ হতে শেখায়।

দান করার সঠিক উপায়

দান করার সময় কিছু বিষয় মনে রাখা উচিত। শাস্ত্রে বলা হয়েছে:

  • প্রাপকের যোগ্যতা দেখুন: অযথা এমন কাউকে দান করবেন না, যে দানের অপব্যবহার করবে। দানের সার্থকতা তখনই, যখন এটি সঠিক কাজে ব্যবহৃত হয়।
  • গোপনে দান করুন: মহাভারত বলছে, “দান এমনভাবে করুন যেন আপনার ডান হাত জানে না, বাম হাত কী করছে।” গোপনে দান করলে দাতার অহংবোধ বাড়ে না।
  • মানসিকতা শুদ্ধ রাখুন: দান করার সময় মনে কোনও প্রত্যাশা রাখা উচিত নয়।

শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতায় (১৭.২১) বলা হয়েছে:

“যৎ তু প্রত্যুপকারার্থং ফলং, দৃশ্যং চৈব যৎ। দীয়তে চ পরিক্লিষ্টং, তৎ রাজসম উদাহৃতং।”

অর্থাৎ, দান যদি কেবল ফল বা প্রতিদানের জন্য করা হয়, তবে তা সত্ত্বগুণের মধ্যে পড়ে না।

আধুনিক সমাজে দানের ভূমিকা

আমাদের বর্তমান সমাজেও দানের গুরুত্ব অপরিসীম। আমি দেখেছি, অনেক মানুষ তাদের উপার্জনের একটি অংশ দান করে বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে। এর ফলে শুধু সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মানুষই উপকৃত হন না, বরং দাতাও একটি অভ্যন্তরীণ সুখ অনুভব করেন।

কিছু বাস্তবধর্মী উপায়:

  • স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দান করুন।
  • চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা দিন।
  • অন্ন বা বস্ত্র দান করুন।
  • ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে দান করুন।

দান ও ধর্মীয় উৎসব

আমাদের ধর্মীয় উৎসবগুলির সাথেও দানের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দীপাবলি বা মকর সংক্রান্তির সময় অনেকেই দরিদ্রদের মধ্যে মিষ্টি, পোশাক বা অর্থ দান করেন। এই সময় দান করা শুধু ঐতিহ্য নয়, এটি আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির একটি অংশ।

শেষ কথা

সনাতন ধর্মে দান করার গুরুত্ব বোঝা মানে নিজের অন্তরের এক নতুন দরজা খুলে দেওয়া। দান করার মাধ্যমে আপনি শুধু অপরের জীবনই বদলান না, নিজের জীবনকেও উন্নত করেন। আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, “আপনি আজ কী এমন কিছু দান করবেন, যা কারও জীবন বদলে দিতে পারে?”

ভাবুন, এবং আপনার হৃদয়কে খুলে দিন – কারণ সনাতন ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, “দানই প্রকৃত ধর্ম।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top