আপনি যদি সনাতন ধর্মে জীবনের পথপ্রদর্শক নীতিগুলো অনুসরণ করেন, তবে আপনার কাছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যাবে। সনাতন ধর্ম শুধু আধ্যাত্মিকতার উপর ভিত্তি করে নয়, বরং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও সঠিক পথ দেখায়। দুর্নীতি, যা অন্যায়, অসত্য এবং অধর্মের প্রতীক, সনাতন ধর্মে সর্বদাই নিন্দিত। এখানে আমি আপনাকে সনাতন ধর্মের কয়েকটি মূল শাস্ত্র এবং তাদের নির্দেশনা সম্পর্কে বলবো, যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন করে।
ধর্ম ও দুর্নীতি
ধর্ম শব্দটির অর্থই হলো ‘ধারণ করা’ বা জীবনের সঠিক নিয়ম অনুসরণ করা। দুর্নীতি বা অন্যায়ভাবে অর্থোপার্জন, অসত্য ভাষণ এবং অধর্মের পথে চলা “অধর্ম” হিসেবে বিবেচিত হয়। “ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ” শ্লোকটি বলে, যদি তুমি ধর্ম রক্ষা করো, তবে ধর্মও তোমাকে রক্ষা করবে। সুতরাং, দুর্নীতি থেকে দূরে থাকা কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের আত্মার জন্যও অপরিহার্য।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সনাতন ধর্মের নির্দেশনা
- সত্য এবং অসত্যের পার্থক্য “সত্যমেব জয়তে নানৃতং” (“সত্যই জয়লাভ করে, মিথ্যা নয়”) — মুণ্ডক উপনিষদ।
এই শ্লোকটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, দীর্ঘমেয়াদে সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্নীতি মিথ্যার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় এবং এটি কখনোই স্থায়ী হতে পারে না। আপনি যদি সৎপথে চলেন, তবে জীবনের যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবেন।
- অহিংসা এবং অন্যায় প্রতিরোধ সনাতন ধর্মে অহিংসা একটি প্রধান নীতি। তবে, অহিংসা মানে দুর্নীতির প্রতি নীরব থাকা নয়। শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন:
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।” (গীতা ৪.৭)
অর্থাৎ, যখনই ধর্ম লুপ্ত হয় এবং অধর্ম বৃদ্ধি পায়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করাও আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব।
- অন্যের সম্পত্তি বা অধিকার নেওয়া নিষিদ্ধ ঋগ্বেদের একটি শ্লোক বলে: “মা গ্রধঃ কস্যস্বিদ্ধনম” (“অন্যের সম্পত্তির লোভ করো না”)। দুর্নীতি সাধারণত লোভ থেকে আসে। কিন্তু আপনি যদি এই নীতিটি মেনে চলেন, তবে দুর্নীতির কোনো স্থান থাকবে না।
- ধন এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার সনাতন ধর্ম বলে, অর্থ বা সম্পদ হলো ঈশ্বরের দান। এটি সঠিক পথে ব্যবহার করা আমাদের কর্তব্য। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে: “ইষে বসুধেয়ম।” (“যথার্থ পথে সম্পদ অর্জন করো”)।
দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ কখনোই শান্তি বা সুখ আনতে পারে না। এটি কেবল ক্ষতি এবং অবমাননাই বয়ে আনে।
- কর্মফলের নীতি শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতায় কর্মফলের নীতি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে: “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” (গীতা ২.৪৭)
আপনি কর্মে অধিকারী, কিন্তু তার ফলের উপর নয়। দুর্নীতি সেই ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায় যারা অবৈধ উপায়ে ফল পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সনাতন ধর্ম আমাদের শিক্ষা দেয়, সৎপথে থেকে নিজের কর্তব্য পালন করলেই সঠিক ফল মিলবে।
দুর্নীতির উদাহরণ এবং সনাতন ধর্মের প্রতিক্রিয়া
- রাজনীতিতে দুর্নীতি মহাভারতের দ্রৌপদীর চীরহরণের ঘটনা রাজনীতিতে দুর্নীতির একটি উদাহরণ। দুর্যোধন এবং তার ভাইদের লোভ এবং অন্যায় আচরণ কৌরবদের পতন ডেকে আনে। এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে, অন্যায় এবং দুর্নীতির পথ কখনোই টিকে থাকে না।
- ব্যবসায়িক দুর্নীতি শ্রীকৃষ্ণ যখন কংসকে পরাজিত করেছিলেন, তখন তিনি দেখিয়েছিলেন যে অন্যায়ভাবে ধনসম্পদ দখল করা এবং জনসাধারণকে শোষণ করা ঈশ্বর কখনোই মেনে নেন না।
- ব্যক্তিগত জীবনে দুর্নীতি রামের বনবাসের সময় কেকেয়ী মাতার দুর্নীতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত লক্ষ্মণের মতো সৎ চরিত্রদের কষ্ট দিয়েছিল। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, নিজের সুবিধার জন্য মিথ্যা এবং অন্যায় পথ বেছে নেওয়া কেবল নিজের নয়, অন্যদের জীবনেও অশান্তি আনে।
আপনি কীভাবে দুর্নীতিমুক্ত জীবনযাপন করবেন?
- সত্যনিষ্ঠা বজায় রাখুন আপনি যদি সৎ থাকেন, তবে দুর্নীতি কখনোই আপনাকে আকৃষ্ট করতে পারবে না। প্রতিদিনের জীবনে সত্যবাদিতা চর্চা করুন।
- সংযম এবং সন্তুষ্টি চর্চা করুন লোভ দুর্নীতির মূল। ঋগ্বেদের উপদেশ অনুসারে, সংযম ও সন্তুষ্টি আপনাকে দুর্নীতিমুক্ত জীবনযাপন করতে সাহায্য করবে।
- সতর্ক থাকুন দুর্নীতিকে সমাজ থেকে নির্মূল করার জন্য সচেতনতা অত্যন্ত প্রয়োজন। আপনি যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস করেন, তবে এটি অনেক পরিবর্তন আনতে পারে।
- শাস্ত্র অধ্যয়ন করুন প্রতিদিন গীতা, উপনিষদ, এবং বেদের পাঠ চর্চা করলে আপনি আত্মশুদ্ধির পথে এগিয়ে যাবেন এবং দুর্নীতির প্রতি বিরাগ তৈরি হবে।
উপসংহার
সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা হলো সত্য, ন্যায়, এবং ধর্মের পথে চলা। দুর্নীতি এই মূল্যবোধের পরিপন্থী। আপনাকে শুধু নিজেকে সৎ রাখতে হবে না, বরং সমাজকেও দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। ভাবুন তো, যদি প্রতিটি ব্যক্তি শাস্ত্রের এই শিক্ষা গ্রহণ করে, তবে সমাজ কতটা সুন্দর হতে পারে? সুতরাং, আসুন আমরা সকলে মিলে সনাতন ধর্মের আদর্শ মেনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াই।