আমাদের সনাতন ধর্মে প্রতিটি জীবের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আপনি জানেন কি, আমরা যখন কোনো জীবের প্রাণহানি ঘটাই, তখন সেই ঈশ্বরের সৃষ্টির ওপরই আঘাত হানা হয়? জীব হত্যা না করার শিক্ষা আমাদের শিখিয়ে দেয় কেবল সহানুভূতির নয়, প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার গুরুত্বও।
সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষার ভিত্তি
সনাতন ধর্মের প্রতিটি শাস্ত্রেই জীব হত্যা না করার গুরুত্ব আলোকিত হয়েছে। “অহিংসা পরমো ধর্ম:” (মহাভারত, শান্তি পর্ব ২৬২.৫)। এই একটি শ্লোকই বলে দেয় যে অহিংসাই সর্বোচ্চ ধর্ম। এটি কেবলমাত্র মানুষের মধ্যেই নয়, সমস্ত জীবের প্রতিই প্রযোজ্য। আপনি যদি ভাবেন, কেন এই শিক্ষা এত গুরুত্বপূর্ণ? চলুন কিছু উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি গভীরভাবে বুঝি।
প্রকৃতি এবং মানবজীবনের সম্পর্ক
আমরা প্রকৃতির অংশ, এবং প্রকৃতি আমাদের অংশ। প্রকৃতি তার ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রতিটি জীবকে একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা দিয়েছে। আপনি কি কখনো ভেবেছেন, যদি আমরা অতিরিক্ত শিকার বা অন্য কারণে জীব হত্যা করি, তবে প্রকৃতি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়? উদাহরণস্বরূপ:
- মৌমাছি হত্যা: মৌমাছি উদ্ভিদের পরাগায়ণ (pollination) করতে সাহায্য করে। যদি আমরা মৌমাছিকে হত্যা করি, তাহলে ফল-ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।
- গরু বা অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণী হত্যা: গরু গোবর দিয়ে জমি উর্বর করে। এটি বন্ধ হলে কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।
- শিকারিদের কারণে বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তি: খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে পড়লে মানুষের ওপর তার প্রভাব পড়ে।
শাস্ত্রের দৃষ্টিতে জীব হত্যা
সনাতন ধর্মের গ্রন্থগুলিতে জীব হত্যার ফলাফল নিয়ে অনেক উপদেশ দেওয়া হয়েছে। “যঃ সর্বাণি ভূতানি আত্মনৈব অনুপশ্যতি। সর্বভূতেষু চ আত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে।” (ঈশোপনিষদ ৬) – এই শ্লোকে বলা হয়েছে, যিনি সমস্ত জীবকে নিজের আত্মা হিসেবে অনুভব করেন এবং নিজের আত্মাকে সমস্ত জীবের মধ্যে দেখতে পান, তিনি কখনো কোনো ক্ষতি করতে পারেন না।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ
আপনি নিশ্চয়ই মহাবীর জৈনদের কথা শুনেছেন। তাঁদের জীবন ছিল অহিংসার জীবন্ত উদাহরণ। তাঁরা মাটির ওপর দিয়ে হাঁটার সময়ও জীবের ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করতেন।
একটি গল্প মনে পড়ে:
একবার এক সাধু একটি পিঁপড়ার কামড়ে ব্যথিত হলেন। তিনি সেই পিঁপড়াকে মারতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন। তিনি মনে করলেন, “এই ক্ষুদ্র পিঁপড়ারও জীবনের অধিকার রয়েছে। আমার কি অধিকার আছে তাকে হত্যা করার?”
আমরা যদি নিজেদের জিজ্ঞাসা করি, “আমি এই পৃথিবীতে অন্য জীবের জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকার কোথায় পেলাম?” তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
আধুনিক যুগে জীব হত্যার প্রভাব
আজকের যুগে অতিরিক্ত মাংস ভক্ষণ ও প্রাণী শিকার আমাদের পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলছে। আপনি কি জানেন, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ প্রাণী শুধুমাত্র খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়? এর ফলে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ প্রাণী পালন শিল্প প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে।
বেদে উল্লেখিত “মাতৃ দেবো ভব, পিতৃ দেবো ভব” এর পাশাপাশি প্রকৃতিকে রক্ষা করার বার্তাও রয়েছে। আমরা যদি সমস্ত প্রাণীকে প্রকৃতির একটি অংশ মনে করে তাদের রক্ষা করি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে পারব।
জীব হত্যা না করার মাধ্যমে অর্জিত শান্তি
আপনার মনে হতে পারে, জীব হত্যা না করলে আপনার জীবনে কী লাভ হবে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আপনাকে একটি ছোট উদাহরণ দিই:
গৌতম বুদ্ধের সময় এক ব্যক্তি পশু বলি দিতে যাচ্ছিল। বুদ্ধ তাকে থামিয়ে বললেন, “তুমি কি মনে করো এই বলি দিয়ে ঈশ্বর খুশি হবেন? বরং তুমি যদি সেই প্রাণীকে রক্ষা করো, তবে ঈশ্বরের আনন্দ হবে।” ব্যক্তি তার ভুল বুঝতে পেরে বলি বন্ধ করেন এবং তার জীবনে নতুন আলোর সন্ধান পান।
আপনি কীভাবে এই শিক্ষা প্রয়োগ করবেন
- অহিংস জীবনযাপন শুরু করুন: আপনি প্রতিদিনের জীবনে ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়ে অহিংসা পালন করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, মাংস ভক্ষণ কমানো বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা।
- প্রকৃতিকে সুরক্ষিত রাখুন: আপনার চারপাশের জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শন করুন।
- অন্যদের প্রেরণা দিন: পরিবার এবং বন্ধুদের এই শিক্ষার গুরুত্ব বোঝান।
শেষ কথা
জীব হত্যা না করার শিক্ষা আমাদের কেবলমাত্র সনাতন ধর্মের অনুসরণ করতেই শেখায় না, বরং এটি আমাদের জীবনকে শান্তিপূর্ণ, সুখী এবং অর্থপূর্ণ করে তোলে।
শেষে আপনাকে একটি প্রশ্ন ছেড়ে যেতে চাই: আপনি কি আজ থেকে প্রতিটি জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শন করার প্রতিজ্ঞা করতে পারেন? সনাতন ধর্মের পথে চলুন এবং প্রকৃতির প্রতি আপনার দায়িত্ব পালন করুন।