আমার মতে, অহিংসা সনাতন ধর্মের একটি মূল ভিত্তি যা আমাদের জীবনে শান্তি ও সম্প্রীতি বয়ে আনতে পারে। এটি শুধু একটি নৈতিক দিক নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণ করার মতো একটি সর্বজনীন জীবনদর্শন। অহিংসার মূল শিক্ষাটি আমাদের জীবনে কতটা প্রাসঙ্গিক এবং এটি কিভাবে আপনার জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে, সেটি আজ আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
অহিংসার ধারণা ও তার গুরুত্ব
অহিংসা শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো “হিংসা থেকে বিরত থাকা।” সনাতন ধর্মে এটি শুধু শারীরিক ক্ষতি থেকে বিরত থাকার বার্তা দেয় না, বরং মন, বাক্য, ও কর্মে হিংসা ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। ভগবদ্ গীতায় বলা হয়েছে:
“অহিংসা সত্যং অক্রোধঃ ত্যাগঃ শান্তিরাপৈশুনম্।” (ভগবদ্ গীতা ১৬.২)
অর্থাৎ, অহিংসা, সত্য, ক্রোধহীনতা, ত্যাগ এবং শান্তি মানুষের চরিত্রের শ্রেষ্ঠ গুণ। এই গুণগুলো অর্জন করলে আমরা প্রকৃত অর্থে মানবিকতা ও আত্মার শান্তি লাভ করতে পারি।
অহিংসা ও ব্যক্তিগত জীবন
আপনার দৈনন্দিন জীবনে অহিংসার প্রয়োগ কেমন হতে পারে? প্রথমে আপনাকে বুঝতে হবে যে, অহিংসা কেবল অন্যের প্রতি নয়, নিজের প্রতিও প্রযোজ্য। অনেক সময় আমরা নিজেদের সঙ্গে এমন আচরণ করি যা আমাদের মানসিক বা শারীরিক ক্ষতি করে। নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়াও অহিংসার একটি রূপ।
আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার এক বন্ধু প্রতিদিন স্কুলে একটি গাছকে পানি দিত। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এটা কেন করো?” সে বলেছিল, “প্রতিটি জীবের প্রতি দয়া দেখানোই অহিংসা।” সেই ছোট উদাহরণ থেকেই আমি শিখেছি যে, অহিংসা মানে শুধু আঘাত না করা নয়, বরং প্রতিটি জীবের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি দেখানো।
আপনিও কি ভেবে দেখেছেন, আপনি কীভাবে আপনার জীবনে অহিংসাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন? আপনার কথাবার্তায়, আচরণে, এমনকি চিন্তায়ও যদি আপনি হিংসা ত্যাগ করেন, তবে আপনার জীবন আরও সুখময় হয়ে উঠবে।
সমাজে অহিংসার প্রভাব
আমাদের সমাজে অহিংসার ধারণা যদি প্রসারিত হয়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজেই সম্ভব। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন এর একটি জীবন্ত উদাহরণ। তিনি বলেছিলেন:
“অহিংসা মানবজাতির সবচেয়ে বড় শক্তি। এটি একটি এমন শক্তি যা তলোয়ার বা অস্ত্র থেকেও বেশি শক্তিশালী।”
এই নীতি অবলম্বন করেই তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং ভারতকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। আজ যদি আমরা আমাদের পারিবারিক, সামাজিক বা জাতীয় সমস্যাগুলোর সমাধানে অহিংসার পথ বেছে নিই, তাহলে সেই সমাধান দীর্ঘস্থায়ী এবং শান্তিপূর্ণ হবে।
যেমন ধরুন, আপনার অফিসে কোনো সহকর্মীর সঙ্গে মতবিরোধ হলো। যদি আপনি তর্ক বা রাগের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করতে যান, তবে সমস্যাটি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যদি আপনি শান্ত এবং সহানুভূতিশীল থেকে তার সঙ্গে আলোচনা করেন, তাহলে সমস্যার সমাধান আরও সহজ হয়ে উঠবে।
প্রকৃতি ও অহিংসা
সনাতন ধর্ম প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং তার সঙ্গে সহাবস্থানের শিক্ষা দেয়। অহিংসা শুধু মানুষের জন্য নয়, সমস্ত জীবের প্রতি প্রযোজ্য। যজুর্বেদে বলা হয়েছে:
“মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিব্যাঃ।”
অর্থাৎ, পৃথিবী আমাদের মা এবং আমরা তার সন্তান। মায়ের প্রতি যেমন সন্তানের দায়িত্ব থাকে, তেমনই প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে। গাছ কাটা, জল দূষণ করা বা প্রাণীদের হত্যা করা প্রকৃতির প্রতি হিংসারই একটি রূপ। আপনি যদি প্রকৃতির প্রতি অহিংসা প্রদর্শন করেন, তাহলে প্রকৃতিও আপনাকে তার দয়া ও করুণা দিয়ে পুরস্কৃত করবে।
ধর্মীয় গ্রন্থে অহিংসার স্থান
সনাতন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে অহিংসার গুরুত্ব বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে:
“অহিংসা পরমো ধর্মঃ।”
অর্থাৎ, অহিংসাই সর্বোচ্চ ধর্ম।
একইভাবে, মহাভারতে অহিংসাকে ধর্মের মূল ভিত্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাভারতের শান্তি পর্বে বলা হয়েছে:
“সর্বভূতেষু যঃ স্নেহঃ স অহিংসা ইতি স্মৃতাঃ।”
অর্থাৎ, সমস্ত জীবের প্রতি স্নেহ ও সহানুভূতিই হলো অহিংসা।
আপনার জীবনেও যদি আপনি এই শিক্ষাগুলো অনুসরণ করেন, তাহলে আপনি নিজের মধ্যে একটি গভীর শান্তি অনুভব করবেন এবং আপনার আশপাশের মানুষও আপনার আচরণে অনুপ্রাণিত হবে।
আধুনিক জীবনে অহিংসার প্রয়োজনীয়তা
আজকের দিনে, যখন আমরা প্রযুক্তি এবং আধুনিকতায় ডুবে আছি, তখন অহিংসার নীতি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দুনিয়ায় আমরা প্রায়ই এমন মন্তব্য বা পোস্ট দেখি যা হিংসাত্মক বা আক্রমণাত্মক। আপনি যদি সচেতনভাবে শান্তিপূর্ণ এবং ইতিবাচক আচরণ করেন, তবে সেটি অন্যদের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
ধরুন, আপনি ট্র্যাফিকে আটকে আছেন এবং কেউ হঠাৎ আপনার গাড়ির সামনে ঢুকে পড়ল। আপনি যদি রাগের বশে চিৎকার করেন, তাহলে আপনার নিজের মানসিক শান্তি নষ্ট হবে। কিন্তু যদি আপনি ধৈর্য ধরে বিষয়টি মেনে নেন, তাহলে আপনার দিনটি আরও শান্তিপূর্ণ হতে পারে।
অহিংসা: জীবনের প্রকৃত অর্থ
অহিংসা আমাদের শুধু শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনেই সহায়তা করে না, এটি আমাদের আত্মার পরিশুদ্ধির জন্যও অপরিহার্য। অহিংসার মাধ্যমে আমরা জীবনের গভীর অর্থ বুঝতে পারি। এটি আমাদের শিখায় কিভাবে প্রকৃত আনন্দ এবং শান্তি লাভ করা যায়।
আমি যখনই কোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, অহিংসার শিক্ষাগুলো আমাকে পথ দেখায়। এটি আমাকে শুধু সমস্যার সমাধানই শেখায় না, বরং সেই সমস্যার গভীরে গিয়ে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
উপসংহার
অহিংসা সনাতন ধর্মের একটি অপরিহার্য দিক যা আমাদের জীবনে শান্তি, সহানুভূতি এবং প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার বোধ নিয়ে আসে। এটি আমাদের শিখায় কিভাবে অন্যের সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করতে হয়। আজকের দিনে, যখন হিংসা ও ক্রোধ আমাদের চারপাশে বেড়ে চলেছে, তখন আপনার জীবনেও অহিংসার নীতি গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
তাহলে আপনি কি আপনার জীবনে অহিংসার শিক্ষাগুলোকে আরও গভীরভাবে আত্মস্থ করবেন? কেমন হবে যদি আমরা সবাই মিলে একটি অহিংস ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলি? এর উত্তর খোঁজা কিন্তু আমাদের সবার দায়িত্ব।