সনাতন ধর্মে অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীলতার গুরুত্ব কী?

সনাতন ধর্মের মৌলিক বার্তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, “একং সদ্ विप्राः बहुधा वदन्ति” — সত্য একটাই, জ্ঞানীরা তাকে বিভিন্ন নামে ডাকেন। এই একটি বাক্য থেকেই বোঝা যায়, সনাতন ধর্মে সহনশীলতার মূল ভিত্তি কতটা গভীর। আমি যখন সনাতন ধর্মের দর্শনের দিকে তাকাই, তখন স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, এটি কেবল নিজের ধর্মের চর্চায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং অন্য ধর্ম, মতবাদ ও বিশ্বাসের প্রতি সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়।

সহনশীলতা এবং মানবজাতির ঐক্যের গুরুত্ব

আপনি যদি আপনার চারপাশে তাকান, দেখবেন পৃথিবী এক বৃহৎ পরিবার। সনাতন ধর্ম এই ধারণা দিয়েছে “বসুধৈব কুটুম্বকম্” — সমগ্র পৃথিবী একটি পরিবার। একজন সনাতনী হিসেবে এই বিশ্বাস আমাদের হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। অন্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল না হলে এই মহৎ দর্শন কেবলই কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।

যেমন ধরুন, মহাত্মা গান্ধীর জীবন। তিনি সনাতন ধর্মে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, তবুও তার জীবনচর্চায় ইসলামের করুণা ও খ্রিস্টান ধর্মের ভালোবাসার শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এর কারণ? তিনি জানতেন, প্রতিটি ধর্মের মূল বার্তা মানবতার কল্যাণ। গান্ধীজীর মতো আপনি-আমি যদি বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষা থেকে ভালো কিছু গ্রহণ করি, তাহলে সমাজে সৌহার্দ্য এবং ঐক্য আরও দৃঢ় হবে।

সনাতন ধর্মের শাস্ত্র এবং সহনশীলতার উদাহরণ

গীতার কথা ভাবুন। সেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিচ্ছেন—”समदुःखसुखं धीरं सोऽमृतत्वाय कल्पते।” (ভগবদ্গীতা ২.১৫) — যার অর্থ, সুখ ও দুঃখে সমভাবে ধৈর্যশীল থাকা উচিত। এটি কেবল আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রযোজ্য নয়, ধর্মীয় মতের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। অন্য ধর্মের কোনো মত বা আচরণ আমাদের পছন্দ না হলেও, ধৈর্য এবং সহানুভূতির মাধ্যমে আমরা একটি ইতিবাচক সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

অন্য একটি উদাহরণ হলো উপনিষদ। ঋগ্বেদের একটি বিখ্যাত শ্লোক বলে, “आ नो भद्राः क्रतवो यन्तु विश्वतः।” — সারা বিশ্ব থেকে কল্যাণকর চিন্তা আসুক। এই শ্লোক থেকে বোঝা যায়, সনাতন ধর্ম কেবল নিজের মধ্যে আবদ্ধ নয়। এটি অন্যান্য মতের ভালো দিকগুলোকেও গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে।

সমসাময়িক উদাহরণ

আজকের বিশ্বে ধর্মীয় সহিংসতা এবং অসহিষ্ণুতা দিন দিন বাড়ছে। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, এর সমাধান কী? আমি মনে করি, সনাতন ধর্মের মূল দর্শন গ্রহণ করাই এই সমস্যার সমাধান।

যেমন, ভিন্নধর্মী কোনো উৎসবে অংশগ্রহণের সময় আপনি যদি খোলা মন নিয়ে যান, তাহলে দেখতে পাবেন সেখানেও মানুষ ভালোবাসা এবং শান্তির বার্তা প্রচার করে। সাম্প্রতিককালে আমি এক বন্ধুর সঙ্গে ইফতার মাহফিলে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে অনুভব করলাম, ইসলামের রমজান কেবল সিয়াম সাধনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি আত্মশুদ্ধি এবং সকলের জন্য প্রার্থনার এক বিশাল উদাহরণ।

একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজের দিকে পথচলা

আপনার নিজের ধর্মে অগাধ বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো মানে কখনোই নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে আপস করা নয়। বরং, এটি আপনার আধ্যাত্মিকতাকে আরও উন্নত করে। সনাতন ধর্মের পথ অনুসরণ করতে গেলে আপনাকে কেবল নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই নয়, বরং অন্যদের সঙ্গে মিলে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার দায়িত্বও নিতে হবে।

একটি ঘটনা শেয়ার করি। আমার ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির পাশে একটি গির্জা ছিল। শীতকালে আমরা প্রায়ই ক্রিসমাস উদযাপনে অংশ নিতাম। তখন উপলব্ধি করতাম, খ্রিস্টধর্মের “শান্তি পৃথিবীতে এবং মানবের প্রতি ঈশ্বরের সদিচ্ছা” বার্তা কেবল তাদের নয়, আমাদেরও জীবনে প্রযোজ্য।

আপনার ভূমিকাটি কী?

এখন প্রশ্ন হলো, আপনি নিজে কীভাবে এই সহনশীলতাকে চর্চা করবেন?

  • শ্রদ্ধার মনোভাব গড়ে তুলুন: আপনার চারপাশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের মতবাদ শুনুন এবং সম্মান করুন।
  • বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করুন: এতে আপনি বুঝতে পারবেন যে, প্রতিটি ধর্মের উৎসবের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ভালোবাসা এবং মানবতার কল্যাণ।
  • নিজের ধর্মের মূল শিক্ষা আত্মস্থ করুন: সনাতন ধর্ম আপনাকে সহনশীল হতে শেখায়। সেই শিক্ষাকে জীবনে কাজে লাগান।

শেষকথা

সনাতন ধর্ম আমাদের শিখিয়েছে, “परस्परं भावयन्तः श्रेयः परमवाप्स्यथ।” — পরস্পরের কল্যাণে নিজেকে নিযুক্ত করুন, এতে সর্বোত্তম মঙ্গল লাভ হবে। তাই আপনি যদি সত্যিই সনাতন ধর্মের মূল আদর্শে বিশ্বাস করেন, তবে অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া আপনার নৈতিক কর্তব্য।

আমি আপনাকে একবার ভেবে দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি: “আপনি কি আপনার জীবনে সনাতন ধর্মের সহনশীলতার আদর্শকে সঠিকভাবে চর্চা করছেন? আপনি কি অন্য ধর্মের প্রতি আপনার মনোভাব দিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়তে ভূমিকা রাখছেন?”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top