আত্মসংযমের গুরুত্ব নিয়ে সনাতন ধর্ম কী বলে?

আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন আত্মসংযম আপনার জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আমরা যখন সনাতন ধর্মের পথে চলি, তখন আত্মসংযম শুধু একটি নীতি নয়, এটি আমাদের জীবনের ভিত্তি হয়ে ওঠে। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্র ও গ্রন্থে এর তাৎপর্য অত্যন্ত গভীরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আজ আমি আপনাকে এই বিষয়ে আলোকপাত করব এবং দেখাব আত্মসংযম আপনার জীবনকে কেমন উন্নত করতে পারে।

আত্মসংযমের অর্থ এবং তাৎপর্য

আত্মসংযম বলতে আমরা বুঝি নিজের ইচ্ছা, কামনা ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। সনাতন ধর্মে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (৬.৫) শ্লোকে বলা হয়েছে:

“উদ্ধরেদ আত্মনা আত্মানং, ন আত্মানমবসাদয়েত।
আত্মৈব হ্যাৎmano বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।”
(তোমার আত্মাই তোমার বন্ধু, আবার আত্মাই তোমার শত্রু। নিজের আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করাই জীবনের শ্রেষ্ঠ পথ।)

অর্থাৎ, যদি আপনি নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তবে আপনার আত্মাই আপনার বন্ধু হয়ে উঠবে। কিন্তু যদি তা না পারেন, তবে আপনার মনই শত্রু হয়ে উঠবে।

আত্মসংযমের উদাহরণ

  •  কামনা নিয়ন্ত্রণ: আমাদের প্রাচীন ঋষি-মুনিরা বলতেন, অতিরিক্ত কামনা বা লালসা মানুষের পতনের প্রধান কারণ। উদাহরণস্বরূপ, মহাভারতে দুর্যোধন তার লোভ ও ঈর্ষা সংযত করতে না পারায় কৌরবদের সমগ্র বংশ ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে, যুধিষ্ঠিরের আত্মসংযম ও সত্যনিষ্ঠা তাকে সত্যিকারের নেতা বানিয়েছিল।
  •  আহার সংযম: আমাদের শাস্ত্রে আহার নিয়ন্ত্রণের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যোগ সূত্রে বলা হয়েছে:

“যুক্তাহার বিহারস্য, যুক্তচেষ্টস্য কর্মসু।”
(আহার ও কার্যকলাপে সংযম হল যোগ সাধনার প্রথম ধাপ।)

যখন আপনি আপনার খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে শিখবেন, তখনই আপনি আপনার ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। একজন যোগীর জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  •  ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ: আত্মসংযমের আরেকটি বড় উদাহরণ হলো ক্রোধ সংযম। রামায়ণে আমরা দেখি, ভগবান রাম ক্রোধের বদলে ধৈর্য ও সংযমের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলেছেন। এটি আমাদের শেখায়, ক্রোধ কখনও সমাধান নয়।

কেন আত্মসংযম প্রয়োজন?

আমরা যারা দৈনন্দিন জীবনে সনাতন ধর্মের আদর্শ পালন করতে চাই, তাদের জন্য আত্মসংযম একটি অপরিহার্য গুণ। এটি আমাদের ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে, যা আমাদের ধ্যান ও যোগাভ্যাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনু সংহিতাতে বলা হয়েছে:

“যো ন হৃষ্যতি ন দ্বেষ্ঠি, ন শোচতি ন কাঙ্খতি।
শুভাশুভপরিত্যাগী, ভক্তিমান্যঃ স মেয প্রিয়ঃ।”
(যে ব্যক্তি কাম, ক্রোধ ও শোক ত্যাগ করতে পারে, সে-ই প্রকৃত ভক্ত।)

আমাদের শাস্ত্র মতে, আত্মসংযম না থাকলে মানুষ কখনও প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে পারে না। এটি কেবল আমাদের ব্যক্তিগত উন্নতিই ঘটায় না, এটি আমাদের চারপাশের মানুষের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।

কিভাবে আত্মসংযম অনুশীলন করবেন?

  • ধ্যান এবং যোগাভ্যাস: প্রতিদিন নিয়মিত ধ্যান করুন। এটি আপনার মনকে শান্ত করবে এবং আপনাকে সংযমে সাহায্য করবে।
  •  সৎসঙ্গ: এমন লোকেদের সঙ্গে থাকুন যারা ইতিবাচক এবং আধ্যাত্মিক। সৎসঙ্গ আপনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।
  •  সংযমের ছোট ছোট অভ্যাস: প্রতিদিন নিজের কোনো একটি ইচ্ছাকে সংযত করার চেষ্টা করুন। এটি ধীরে ধীরে একটি অভ্যাসে পরিণত হবে।
  •  শাস্ত্র অধ্যয়ন: প্রতিদিন গীতা, উপনিষদ বা অন্য কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ুন। সেগুলি আপনার মনোভাবকে উন্নত করবে।

সনাতন ধর্মে আত্মসংযমের গুরুত্ব

সনাতন ধর্মে আত্মসংযম শুধু ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়, এটি সমাজের কল্যাণেও অপরিহার্য। আমরা যদি আমাদের ইন্দ্রিয় ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখি, তবে আমাদের আশপাশের পরিবেশও ইতিবাচক হয়ে উঠবে। যেমন ঋগ্বেদ বলে:

“ধর্মং চর, সত্যং বল।”
(ধর্মের পথে চলো, সত্যকে শক্তি হিসেবে গ্রহণ করো।)

আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যদি আমরা আত্মসংযম পালন করি, তবে আমরা প্রকৃত সুখ ও শান্তি অর্জন করতে পারব।

শেষ কথা

আপনি কি আত্মসংযমের পথে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত? সনাতন ধর্ম আমাদের শুধু পথ দেখায় না, এটি আমাদের মনকে সংযত করার শিক্ষা দেয়। আজ থেকে একটি ছোট পদক্ষেপ নিন এবং দেখুন কিভাবে আপনার জীবন বদলে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top