কর্ম এবং তার ফলাফলের নৈতিক তাৎপর্য কী?

কর্ম — এই একটি শব্দ আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে বেড়ায়। আমরা সবাই প্রতিদিন কিছু না কিছু কর্ম করে চলি, কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে, আবার কখনও অজান্তে। কিন্তু কর্মের সাথে তার ফলাফলও যুক্ত থাকে, আর সেই ফলাফল নিয়েই আমরা কখনো আনন্দিত, কখনো হতাশ।

সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা আমাদের বলে, “কর্ম করো, কিন্তু ফলাফলের আশা ত্যাগ করো।”

এই নীতিটি শুধুমাত্র দর্শনের কথা নয়, এটি আমাদের জীবনে নৈতিক ও আত্মিক উন্নতির পথও দেখায়। আজ আমরা আলোচনা করব কর্ম এবং তার ফলাফলের নৈতিক তাৎপর্য নিয়ে।

কর্ম কী এবং এর গুরুত্ব কী?

‘কর্ম’ বলতে বোঝায় প্রত্যেকটি চিন্তা, কথা এবং কাজ যা আমরা করি। সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, কর্ম শুধু শারীরিক কাজ নয়, আমাদের মন ও বাক্যের মাধ্যমে যা কিছু সম্পাদিত হয়, তাও কর্মের অন্তর্ভুক্ত। গীতা আমাদের স্পষ্টভাবে বলে:

“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ২.৪৭)

অর্থাৎ, “তোমার অধিকার শুধুমাত্র কর্মে, কিন্তু কর্মের ফলাফলের ওপর তোমার কোনো অধিকার নেই।”

এই একটি বাক্যের মধ্যে জীবনের গভীর সত্য লুকিয়ে আছে। আমরা যখন শুধুমাত্র কর্মের ওপর ফোকাস করি এবং ফলাফলের আশা করি না, তখন আমাদের মধ্যে কোনো হতাশা, দ্বন্দ্ব বা দুঃখ থাকে না।

কর্ম এবং ফলাফল: বাস্তব উদাহরণ

১. কৃষকের উদাহরণ:
একজন কৃষক জমিতে বীজ বপন করেন। তিনি পরিশ্রম করেন, জমি চাষ করেন, জল দেন, কিন্তু ফলন কী হবে তা তিনি নিশ্চিত জানেন না। তিনি জানেন, তার কর্তব্য হলো সঠিকভাবে পরিশ্রম করা, ফল আসবে কি না, তা প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। কৃষকের এই মনোভাবই প্রকৃত কর্মযোগের উদাহরণ।

২. শিক্ষার্থীর উদাহরণ:
একজন শিক্ষার্থী তার পড়াশোনায় মন দেয়, পরিশ্রম করে। কিন্তু পরীক্ষার ফল কী হবে, তা তার হাতে নেই। যদি সে শুধুমাত্র ফলের চিন্তা করেই পড়াশোনা করে, তাহলে তার মানসিক চাপ বাড়বে। কিন্তু যদি সে পড়াশোনাকে একটি কর্ম হিসেবে গ্রহণ করে, তখন সে শান্ত ও আনন্দিত থাকবে।

৩. শ্রীকৃষ্ণের জীবন থেকে শিক্ষা:
মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ নিজে কখনোই ব্যক্তিগত লাভ বা ক্ষতির চিন্তা করেননি। তিনি সব সময় ধর্ম ও সত্যের পথে থেকে কাজ করেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও তিনি অর্জুনকে শুধুমাত্র কর্মের পথেই চলার উপদেশ দিয়েছিলেন।


কর্মফল: আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি

সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, প্রত্যেক কর্মের একটি ফল আছে। কখনো সেই ফল আমরা সাথে সাথেই দেখতে পাই, আবার কখনো তা সময়ের গর্ভে লুকিয়ে থাকে। একে বলা হয় “কর্মফল” বা “কার্মিক রিটার্ন”। গীতা এবং উপনিষদে এই বিষয়ে বহুবার আলোচনা করা হয়েছে:

“যথা কর্ম তথা ফল।”
(অর্থাৎ, যেমন কর্ম করবে, তেমনই ফল পাবে।)

কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, কর্মের ফল কখনোই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এই সত্য বুঝতে পারলেই আমরা আমাদের অহংকার এবং আত্মতৃপ্তি থেকে মুক্ত হতে পারব।


কর্মযোগের দর্শন: একান্ত মনোভাব

‘কর্মযোগ’ হলো সনাতন ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন:

“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।”
(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ২.৫০)

অর্থাৎ, “কর্মে দক্ষতা এবং একাগ্রতাই যোগ।”

কর্মযোগ হলো নিজের দায়িত্ব পালন করা এবং ফলাফলের আশা ছেড়ে দেওয়া। এটি একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে কর্মই উপাসনা হয়ে ওঠে। আপনি যদি কর্মকে নিজের কর্তব্য হিসাবে দেখেন, ফল নিয়ে চিন্তা না করেন, তাহলে জীবনে সুখী হবেন এবং মানসিক শান্তি পাবেন।


কেন ফলাফলের আশা আমাদের বঞ্চিত করে?

কর্মের পর যখন আমরা ফলাফলের আশায় থাকি, তখন আমাদের মনে অহংকার, লোভ বা হতাশা তৈরি হয়। যেমন ধরুন:

  • যদি ভালো ফল পাই, আমরা অহংকারী হয়ে উঠি।
  • যদি খারাপ ফল পাই, আমরা হতাশ হয়ে পড়ি।
  • কোনো কোনো সময় ফল না পেয়ে আমরা কর্ম করতে অনীহা অনুভব করি।

এইসব মানসিক অবস্থার কারণে আমরা নিজের আসল পথ থেকে সরে যাই। সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায়, কর্মই আমাদের সত্য পথ, আর ফল আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।


কর্ম এবং তার নৈতিক দায়িত্ব

আমরা প্রতিদিন সমাজে এবং পরিবারের মধ্যে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করি। একজন পিতা-মাতার দায়িত্ব সন্তানের প্রতি, একজন শিক্ষকের দায়িত্ব ছাত্রের প্রতি। যদি সবাই নিজের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেন, তবে সমাজে নৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে।

উদাহরণস্বরূপ:

  • একজন চিকিৎসকের কাজ হলো রোগীর চিকিৎসা করা, কিন্তু তিনি কি রোগী সুস্থ হবে কি না তা নিশ্চিত করতে পারেন?
  • একজন বিচারকের কাজ হলো ন্যায়বিচার করা, কিন্তু সমাজে শান্তি কতটা প্রতিষ্ঠিত হবে তা তার হাতে নেই।

আমরা যদি ফলাফলের আশা ছেড়ে কেবল ন্যায়ের পথে চলি, তাহলে জীবনে সত্যিকার সাফল্য আসবেই।

শেষ কথা: ভাবার বিষয়

আমাদের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে কর্ম এবং তার ফলাফলের মধ্যে একটি যোগসূত্র কাজ করে। কিন্তু সনাতন ধর্ম আমাদের মনে করিয়ে দেয়:

“নিজের কর্তব্যে স্থির থাকো, কিন্তু ফলের ওপর আকাঙ্ক্ষা করো না।”

এই শিক্ষাটি মেনে চললে আমরা জীবনে সত্যিকারের শান্তি ও সাফল্য পেতে পারি। এখন আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি: আপনার জীবনের কোন ক্ষেত্রে আপনি কর্মকে ফলাফলের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবেন? আপনি কি সত্যিই কর্মকে উপাসনা হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত?

“কর্ম করো, কিন্তু ফলের আশা ছেড়ে দাও। সেই মুহূর্তেই তুমি মুক্তি পাবে।”
(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ২.৪৭)

জয় শ্রীকৃষ্ণ।

আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না। সনাতন ধর্মের নীতি নিয়ে আমাদের আলোচনা অব্যাহত থাকুক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top