সনাতন ধর্মের ঐতিহ্য ও দর্শন আমাদের জীবনযাপনের এক গৌরবময় পথ দেখায়। এটি শুধু আধ্যাত্মিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমাদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্বকেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। প্রাচীন যুগ থেকেই সনাতন ধর্মে মানুষের অধিকার এবং সম্মানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, যদিও সেই ভাষা বা ধারণা আজকের ‘মানবাধিকার’ শব্দের মতো সরাসরি ছিল না। কিন্তু তবুও, সনাতন ধর্মের মূল নীতিগুলো দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন, মানবাধিকার সেখানে বহু আগে থেকেই বিদ্যমান।
আপনার মনে হতে পারে, সনাতন ধর্ম মানবাধিকারকে কীভাবে দেখে? আজকের আলোচনায়, আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব কিছু শাস্ত্রীয় উদাহরণ এবং নীতির মাধ্যমে। আমি নিশ্চিত, সনাতন ধর্মের এই শিক্ষাগুলো আপনাকে জীবনে সঠিক পথে চলতে এবং অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে সাহায্য করবে।
১. “ধর্ম” শব্দের প্রকৃত অর্থ
প্রথমেই আমাদের জানতে হবে সনাতন ধর্মে “ধর্ম” শব্দটির প্রকৃত অর্থ কী। এটি শুধুই একটি ধর্মীয় বিশ্বাস নয়। বরং, এটি এমন এক জীবনযাত্রার পথ যা মানুষকে সত্য, ন্যায় ও মানবিকতার দিকে পরিচালিত করে। “ধর্ম” শব্দের অর্থ “যা ধারণ করে” বা যা আমাদের জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করে।
ভগবদ্গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ॥”
(ভগবদ্গীতা ৬.২৯)
অর্থাৎ, যোগী সেই ব্যক্তি যিনি সকল জীবকে নিজের মতো দেখতে পান এবং নিজেকেও সকল জীবের মধ্যে দেখতে পান। এখানে স্পষ্টতই মানবজাতির মধ্যে সমতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা মানবাধিকারের অন্যতম ভিত্তি।
২. “অহিংসা পরমো ধর্মঃ”
আমরা সবাই জানি, “অহিংসা পরমো ধর্মঃ” কথাটি সনাতন ধর্মের এক মহৎ শিক্ষা। এই নীতি বলে, কারো প্রতি হিংসা না করাই প্রকৃত ধর্ম। অহিংসা শুধু শারীরিক আক্রমণ নয়, বরং এটি মানসিক ও মৌখিক সহিংসতাকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
মহাত্মা গান্ধী অহিংসার এই শিক্ষাকেই তার জীবনের অন্যতম পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন:
“অহিংসা মানে কেবল কাউকে আঘাত না করা নয়, বরং অন্যের প্রতি প্রেম ও সম্মান দেখানো।”
অহিংসার নীতি মানবাধিকার রক্ষায় কীভাবে ভূমিকা রাখে, তা সহজেই বোঝা যায়। যখন আপনি অন্যকে সম্মান করেন এবং আঘাত করা থেকে বিরত থাকেন, তখনই প্রকৃত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. বেদ ও উপনিষদে মানবাধিকারের গুরুত্ব
বেদের মন্ত্রগুলোতে স্পষ্টভাবে মানুষের অধিকার এবং সমতার কথা বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ঋগ্বেদের একটি শ্লোক হলো:
“সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসী জানতাম।”
(ঋগ্বেদ ১০.১৯১.২)
অর্থাৎ, “সবাই একসাথে চল, একসাথে কথা বল, এবং একই চেতনার সাথে কাজ কর।”
এখানে সমাজের ঐক্য এবং সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে, যা আজকের মানবাধিকার আন্দোলনের মূল ভিত্তি। এই ঐক্য সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
৪. রামের রাজ্য ও মানবাধিকার
রামায়ণের আদর্শ রাজা শ্রী রামের কথা আমরা সবাই জানি। তার রাজত্বে কোনো ধরনের বৈষম্য ছিল না এবং জনগণ সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। রামের রাজ্য ছিল সেই সময়ের একটি আদর্শ সমাজ যেখানে প্রত্যেক মানুষের অধিকার রক্ষা করা হত।
“রামো বিরামো মহতি লোকানাং শান্তি বর্ধনঃ।”
অর্থাৎ, রাম ছিলেন সেই রাজা, যিনি সকলের শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করেছিলেন।
এটি একটি বড় উদাহরণ, কীভাবে সনাতন ধর্মে একজন নেতার দায়িত্ব মানবাধিকারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। একজন আদর্শ শাসক তার জনগণের সুখ এবং অধিকার নিশ্চিত করেন, এটিই প্রকৃত ধর্ম।
৫. করুণার মাধ্যমে মানবিকতা
সনাতন ধর্মে করুণাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেওয়া হয়েছে। করুণা এবং দয়ার মাধ্যমে মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং সম্মান প্রকাশ করা হয়। একজন ব্যক্তি যদি অন্যের দুঃখ ও কষ্ট বুঝতে পারেন, তখনই সমাজে প্রকৃত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
“মহাভারত”-এ কর্ণের একটি ঘটনা খুবই বিখ্যাত। কর্ণ দানের জন্য তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবিচল ছিলেন। এটি আমাদের শেখায় যে, মানবিকতা এবং অন্যের প্রতি সাহায্য করা, মানবাধিকারের মূল অংশ।
তোমার ধর্ম তোমাকে কী শিক্ষা দেয়?
সনাতন ধর্মে মানবাধিকার নতুন কিছু নয়। এটি আমাদের শাস্ত্র, উপদেশ এবং ধর্মীয় গ্রন্থে বহু আগে থেকেই বিদ্যমান। অহিংসা, সমতা, করুণা এবং সকল জীবের প্রতি সম্মান—এই নীতিগুলো মানবাধিকারের মূলে রয়েছে।
আপনি যদি সনাতন ধর্মের এই শিক্ষাগুলোকে জীবনে ধারণ করেন, তাহলে শুধুমাত্র নিজের নয়, বরং সমাজেরও উন্নতি নিশ্চিত হবে।
ভেবে দেখুন, আপনি কি সত্যিই নিজের জীবনে অহিংসা, সমতা ও করুণার মতো নীতিগুলো অনুসরণ করছেন? যদি না করেন, তবে আজ থেকেই শুরু করা যাক। কারণ সনাতন ধর্ম বলে—
“ধর্মে সর্বপ্রতিষ্ঠা লোকেশু পরমং সুখম।”
অর্থাৎ, ধর্মই সকলের সুখ এবং শান্তির মূল ভিত্তি।
আপনার কী মনে হয়, সনাতন ধর্মের এই শিক্ষাগুলো আজকের জীবনে মানবাধিকার রক্ষায় কতটা কার্যকর? আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।
শুভেচ্ছাসহ,
আপনার সঙ্গী সত্যের পথে।