চুরি, মিথ্যা বলা বা সহিংসতা সম্পর্কে সনাতন ধর্ম কী বলে?

সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি হলো মানবতার কল্যাণ এবং ধর্মের শাশ্বত সত্য। আমাদের জীবনযাত্রা এবং প্রতিদিনের কাজে যখন আমরা নৈতিক মূল্যবোধ ভুলে যাই, তখনই সমাজে অশান্তি তৈরি হয়। চুরি, মিথ্যা বলা বা সহিংসতা—এই তিনটি কাজ শুধু অপরাধ নয়, এগুলো আমাদের আত্মিক বিকাশেও বাধা সৃষ্টি করে। সনাতন ধর্মের গ্রন্থগুলোতে এই বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আজ আমি এই প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করব, যাতে তুমি নিজের জীবনে সনাতন ধর্মের নীতিগুলো সহজে প্রয়োগ করতে পারো।

চুরি: সম্পদের প্রতি লোভ এবং আত্মিক অবনতি

চুরি মানে অপরের সম্পদকে অন্যায়ভাবে নিজের বলে দাবি করা। এটি শুধু আইনত অপরাধ নয়, বরং একটি আত্মিক পতন। সনাতন ধর্ম বলে যে প্রকৃত সুখ কখনও অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে পাওয়া যায় না। চুরির মূল কারণ হলো লোভ, যা আমাদের মনকে অস্থির করে তোলে।

উদাহরণস্বরূপ, মহাভারতের মহাবলী কর্ণের কথা মনে পড়ে। যদিও তিনি মহাদাতা ছিলেন, কিন্তু কুন্তীর মিথ্যা এবং দ্রোণাচার্যের ষড়যন্ত্রের কারণে কিছু ঘটনায় বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। তার এই বিভ্রান্তি চিরকালের জন্য মহাভারতের যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে:
“অদত্তং ন উপাদেয়ং” (যজুর্বেদ ৩৬.১৮)
অর্থাৎ, যা তোমার নয়, তা কখনো গ্রহণ করবে না।

তুমি যদি চুরি করার চিন্তা কখনো করো, তবে মনে রেখো—এটি তোমার নিজস্ব ধর্ম থেকে বিচ্যুতি ঘটাবে। প্রকৃত সুখ এবং শান্তি আসে সেই সম্পদ থেকে, যা তুমি পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করো।

মিথ্যা বলা: সত্যের পথ থেকে বিচ্যুতি

মিথ্যা বলা হলো সত্যের বিপরীত কাজ। সত্যের পথ সনাতন ধর্মের অন্যতম প্রধান আদর্শ। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, সত্য এমন একটি গুণ যা সব দোষকে দূর করতে পারে।

মনু সংহিতায় বলা হয়েছে:
“সত্যং ব্রূযাত্ প্রিয়ং ব্রূযাত্ ন ব্রূযাত্ সত্যমপ্রিয়ম।”
অর্থাৎ, সত্য কথা বলবে, কিন্তু এমনভাবে বলবে যা মিষ্টি এবং শ্রুতিমধুর হয়। তিক্ত এবং কষ্টদায়ক সত্যও এড়ানো উচিত।

একজন সত্যবাদী মানুষ সমাজে সর্বদা সম্মানিত হন। রামায়ণ থেকে শ্রীরামের উদাহরণ আমরা এখানে নিতে পারি। তিনি রাজধর্ম রক্ষা এবং সত্যের প্রতি অবিচল থাকবার কারণে বনবাসেও শান্ত ছিলেন। তার ব্যক্তিত্ব আমাদের শিখিয়ে দেয় যে সত্য কখনও পরাজিত হয় না।

তুমি যদি জীবনে সফল হতে চাও, তবে সত্যের পথকে অনুসরণ করো। মিথ্যা তোমার জন্য সাময়িক সাফল্য আনতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তোমার জীবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।

সহিংসতা: অহিংসার শক্তি

সহিংসতা মানে অন্যকে কষ্ট দেওয়া, শারীরিক বা মানসিকভাবে। সনাতন ধর্মে সহিংসতাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। অহিংসা হল সবচেয়ে মহান ধর্ম, যা মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধের মতো মহাপুরুষেরা আমাদের শিখিয়েছেন।

ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন:
“অহিংসা সত্যম অক্রোধস্ত্যাগঃ শান্তিরপৈশুনম।” (ভগবদ্গীতা ১৬.২)
অর্থাৎ অহিংসা, সত্যবাদিতা এবং ক্রোধহীনতা মানুষের উন্নতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

একবার মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “অহিংসাই হল সবচেয়ে বড় শক্তি।” অহিংসার মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে সফল হয়েছিলেন। সহিংসতা আমাদের ভেতরের শান্তিকে নষ্ট করে দেয় এবং পরস্পরের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করে।

আমার কাছে একটি প্রশ্ন, তুমি কি জানো যে সহিংসতাহীন সমাজ গড়ার প্রথম পদক্ষেপ কোথায় শুরু হয়? সেটি শুরু হয় তোমার নিজের হৃদয় থেকে। তোমার চিন্তা, কথা এবং কাজের মধ্যে অহিংসার অভ্যাস আনো।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের শিক্ষা

সনাতন ধর্ম আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিশুদ্ধতার শিক্ষা দেয়। চুরি, মিথ্যা এবং সহিংসতা আমাদের জীবনের তেজ, গৌরব এবং মানবতা নষ্ট করে।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক উল্লেখ করতে চাই—

“পরোপকারায় ফলন্তি বৃক্ষাঃ, পরোপকারায় বহন্তি নদ্যঃ।
পরোপকারায় দুঃখন্তি গাবাঃ, পরোপকারার্থমিদং শরীরম।”

অর্থাৎ, গাছ ফল দেয় অন্যের উপকারে, নদী বয়ে চলে অন্যের তৃষ্ণা মেটাতে, গরু দুধ দেয় সকলের জন্য। আমাদের শরীর এবং জীবনও অন্যের উপকারের জন্য উৎসর্গ করা উচিত।

কিভাবে জীবনে এই নীতিগুলো প্রয়োগ করা যায়?

১. আত্মচিন্তা করা: প্রতিদিন নিজের কাজ এবং চিন্তাগুলো বিশ্লেষণ করো। কোথাও ভুল হলে তা স্বীকার করে সংশোধন করো।
২. পরিশ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা: অন্যের সম্পদে লোভ না করে নিজের পরিশ্রমে বিশ্বাস রাখো।
৩. সত্যবাদিতা চর্চা: সত্য কথা বলা এবং অন্যকে বিশ্বাসযোগ্যতা দেওয়ার চেষ্টা করো।
৪. অহিংসার প্রতিশ্রুতি: নিজের মন থেকে ক্রোধ এবং বিদ্বেষ দূর করার চেষ্টা করো।


শেষ কথা

সনাতন ধর্মের এই মূল্যবোধগুলো আমাদের জীবনকে সুন্দর এবং সমৃদ্ধ করে। তোমার জীবনে যদি তুমি সত্য, অহিংসা এবং পরিশ্রমকে স্থান দাও, তাহলে তোমার পথচলা কখনো বন্ধ হবে না। চুরি, মিথ্যা এবং সহিংসতার মতো কাজের মাধ্যমে তুমি সাময়িক সুবিধা পেতে পারো, কিন্তু জীবনের প্রকৃত শান্তি হারিয়ে ফেলবে।

একবার ভেবে দেখো—তুমি যদি প্রতিদিন একটি ভালো কাজ করার সংকল্প নাও, তবে তোমার আশেপাশের পৃথিবী কত সুন্দর হতে পারে?

“তুমি কি আজ থেকে সত্য, পরিশ্রম এবং অহিংসার পথ বেছে নেবে?”


শান্তি ও ভালোবাসার পথে এগিয়ে যাও!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top