আমাদের সনাতন ধর্ম হাজার বছরের প্রাচীন এবং মানবজাতির জন্য সর্বোচ্চ জ্ঞান ও শিক্ষার উৎস। তবে, সাম্প্রতিক কালে লক্ষ্য করছি, এই পবিত্র ধর্মকে কিছু বিশেষ গোষ্ঠী রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। আমি বিশ্বাস করি, তোমার মতো আমরাও এই প্রবণতায় উদ্বিগ্ন। সনাতন ধর্ম এমন এক জীবনপদ্ধতি যা ব্যক্তি ও সমাজকে উন্নত করে তোলে। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এর অপব্যবহার আমাদের সংস্কৃতি এবং ধর্মের প্রকৃত আদর্শকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সনাতন ধর্মের প্রকৃত আদর্শ কী?
সনাতন ধর্মের মূল কথা হল “বসুধৈব কুটুম্বকম্”—“সমস্ত পৃথিবী একটি পরিবার”। এই ভাবনা আমাদের সহিষ্ণুতা, প্রেম এবং মানবতার শিক্ষা দেয়। এছাড়াও, ভগবদ গীতার এই শ্লোকটি বিশেষ প্রাসঙ্গিক:
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।”
(গীতা, অধ্যায় ৪, শ্লোক ৭)
এই শ্লোকটি বলছে যে যখনই ধর্ম অবমানিত হয়, তখন ভগবান নিজেই তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, ধর্মের এই অবমাননা কি শুধুমাত্র আধুনিক রাজনৈতিক কৌশলের ফল?
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সনাতন ধর্মের ব্যবহার: উদাহরণ
- ধর্মীয় উৎসবের রাজনীতিকরণ:
তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ যে, বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব আজ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, রথযাত্রা বা গরবা উৎসবকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের আদর্শকে সমর্থন করে। অথচ, এই উৎসবগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র মানবজাতিকে একত্রিত করা। - মন্দির নির্মাণের প্রতিযোগিতা:
বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, রাজনৈতিক দলগুলি মন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে জনসমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছে। রামমন্দির নির্মাণের মতো প্রকল্পকে শুধুমাত্র ভোটের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ রামায়ণের রাম আমাদের শিখিয়েছেন নম্রতা ও কর্তব্যের মহত্ত্ব। - ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি:
রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা হল “সর্ব ধর্ম সমভাব”, যা সমস্ত ধর্মকে সম্মানের চোখে দেখতে শিখায়। অথচ, আধুনিক রাজনীতিকরা এই ঐক্যের শিক্ষাকে উপেক্ষা করছে। - ধর্মীয় গ্রন্থের অপব্যাখ্যা:
কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী ধর্মীয় গ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। উদাহরণস্বরূপ, তারা ভগবদ গীতা বা বেদের শ্লোকগুলিকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করে জনসাধারণের অনুভূতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। - সামাজিক ইস্যুগুলিকে ধর্মীয় রঙ দেওয়া:
সম্প্রতি কিছু সামাজিক সমস্যা, যেমন পরিবেশ রক্ষা বা নারীর ক্ষমতায়ন, সনাতন ধর্মের শিক্ষার সাথে যুক্ত করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেন এটি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রচেষ্টা।
সনাতন ধর্মের শিক্ষা কি এই প্রবণতাকে সমর্থন করে?
না। সনাতন ধর্ম আমাদের শিখিয়েছে সততা, ন্যায়, এবং মানবসেবার শিক্ষা। মনু স্মৃতিতে বলা হয়েছে:
“ধর্ম্যাং চারিৎ পুরুষঃ পাপ্মানং প্রত্যুহত্য চ।”
অর্থাৎ, ধর্মের পথে চললে পাপের বিনাশ হয়। রাজনীতি যদি সনাতন ধর্মকে তার প্রকৃত শিক্ষার জন্য ব্যবহার করত, তাহলে সমাজে সত্যি পরিবর্তন আসত।
আমরা কী করতে পারি?
তোমার এবং আমার মতো মানুষেরই দায়িত্ব এই প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করা। সনাতন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।
- আদর্শকে অনুসরণ করা:
সনাতন ধর্মের প্রতিটি শিক্ষা আমাদের ব্যক্তি জীবনকে উন্নত করার জন্য। ভগবদ গীতার এই শ্লোক আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
তুমি কাজ করো, কিন্তু ফলের আশা করবে না। এই শিক্ষাই আমাদের নিজেদের কর্তব্যে অবিচল থাকতে সাহায্য করে। - বিভাজনের রাজনীতি থেকে দূরে থাকা:
যদি আমরা প্রত্যেকে নিজের আশেপাশে ধর্মীয় বিভাজন রুখতে পারি, তাহলে সামগ্রিকভাবে সমাজ আরও উন্নত হবে। - সততার সাথে ধর্মের চর্চা করা:
যখন আমরা নিজেদের জীবনে সনাতন ধর্মের প্রকৃত মূল্যবোধগুলি বাস্তবায়ন করব, তখন রাজনৈতিক অপব্যবহার কমে যাবে।
শেষ কথা
সনাতন ধর্মের শিক্ষা চিরন্তন এবং সর্বজনীন। কিন্তু আজ আমরা দেখছি, রাজনৈতিক স্বার্থে এই পবিত্র শিক্ষার অপব্যবহার হচ্ছে। তাই আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, “তুমি কি সনাতন ধর্মকে তার প্রকৃত রূপে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রস্তুত?” মনে রেখো, সত্য এবং ধর্মের পথে হাঁটা সবসময় সহজ নয়, কিন্তু এটাই আমাদের জীবনকে সার্থক করে।
“ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ।”
যদি আমরা ধর্মকে রক্ষা করি, ধর্মও আমাদের রক্ষা করবে। এখন তোমার সিদ্ধান্ত কী?