সনাতন ধর্ম, যাকে আমরা হিন্দু ধর্ম হিসেবেও চিনি, এটি শুধু একটি ধর্ম নয়, বরং একটি জীবনদর্শন। প্রতিটি মানুষের জীবনে দায়িত্বের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দায়িত্ব শুধু পরিবার কিংবা নিজের প্রতি সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমাজ, প্রকৃতি এবং সমগ্র জীবজগতের প্রতিও আমাদের কর্তব্য রয়েছে। সনাতন ধর্ম এই দায়িত্বকে কীভাবে চিহ্নিত করে, সে বিষয়ে আজ আমরা কিছু আলোচনা করব।
দায়িত্বের ধারণা: ধর্ম এবং কর্মের সংমিশ্রণ
সনাতন ধর্মে “ধর্ম” শব্দটি শুধুমাত্র পূজাপাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি “কর্তব্য” এবং “নৈতিক দায়িত্ব” এর প্রতীক। প্রতিটি মানুষকে তার নিজের ধর্ম বা কর্তব্য পালন করতে বলা হয়েছে। যেমন, ভগবদ্গীতা-তে শ্রীকৃষ্ণ বলেন—
“স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।”
(অর্থাৎ নিজের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মৃত্যু হলেও তা শ্রেয়, অন্যের কর্তব্য পালন ভয়ঙ্কর।)
আমাদের জীবনে সামাজিক দায়িত্ব পালন করা স্বধর্মেরই একটি অংশ। সমাজে বাস করতে হলে, আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা প্রয়োজন।
পারিবারিক দায়িত্ব থেকে সমাজের দিকে অগ্রসর
আমরা জানি, “পরিবার হল সমাজের ভিত্তি”। পরিবারে আমাদের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে পারলেই আমরা বৃহত্তর সমাজে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারব। উদাহরণস্বরূপ, একজন গৃহস্থ মানুষের ধর্ম কি?
- পরিবারের প্রতিপালন
- শিক্ষাদান এবং সৎ পথে চালনা
- সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল থাকা
শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে—
“পিতৃণাং প্রজয়া ত্রাণং, আত্মনশ্চ পরম গতি।”
(অর্থাৎ পিতা-মাতার জন্য সন্তানদের প্রতিপালন এবং তাদেরকে সৎ পথে চালিত করা একটি প্রধান দায়িত্ব।)
এখানেই শেষ নয়। পরিবার থেকে শিখে নেওয়া নীতিগুলো সমাজে প্রতিফলিত হয়। সমাজকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার দায়িত্বও আমাদেরই।
সমাজের প্রতি ব্যক্তিগত দায়িত্ব
সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে যে সমাজে আমাদের দায়িত্ব ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা ব্যক্তিগত জীবনে। আমাদের আশপাশের মানুষের প্রতি আচরণ এবং সাহায্য করার মনোভাব জীবনের এক অনিবার্য অংশ। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ তুলে ধরছি—
- দান ও সাহায্য করা
মহাভারত-এ উল্লেখ আছে যে প্রকৃত দান হল নিঃস্বার্থভাবে অন্যকে সাহায্য করা।
“দানং হি পরমং ধর্মং।”
(অর্থাৎ দানই পরম ধর্ম।)
আমাদের উচিত, নিজের সাধ্যমতো অভাবী মানুষকে সাহায্য করা। এটি কেবল আর্থিক দান নয়; জ্ঞান, শ্রম বা সময় দিয়েও মানুষকে সাহায্য করা সম্ভব। - সত্য কথা বলা ও ন্যায়বিচার
সমাজে শান্তি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যবাদী হওয়া অত্যন্ত জরুরি। মনু সংহিতা-তে বলা হয়েছে—
“সত্যং ব্রুইয়াত প্রিয়ং ব্রুইয়াত, ন ব্রুইয়াত সত্যমপ্রিয়ম।”
(অর্থাৎ সত্য বলবে, তবে তা যেন প্রিয় ও কল্যাণকর হয়। কঠোর সত্য বলে কাউকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়।) - প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ব
সনাতন ধর্ম প্রকৃতি এবং পরিবেশকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। গাছপালা, নদী, প্রাণী—সবকিছুই আমাদের পরম বন্ধু। উদাহরণস্বরূপ, ঋগ্বেদে বলা হয়েছে—
“মাতা ভূমি: পুত্রোহম পৃথিব্যা।”
(অর্থাৎ পৃথিবী আমাদের মা এবং আমরা তার সন্তান।)
আমাদের উচিত, বৃক্ষরোপণ করা, নদী পরিষ্কার রাখা এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসা। - আশ্রমব্যবস্থা অনুযায়ী দায়িত্ব
সনাতন ধর্মে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আলাদা দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। আশ্রমব্যবস্থা অনুযায়ী—- ব্রহ্মচর্য আশ্রম: শিক্ষার প্রতি মনোযোগ এবং নৈতিকতা শেখা।
- গার্হস্থ্য আশ্রম: পরিবারের দায়িত্ব পালন এবং সমাজকে সাহায্য করা।
- বানপ্রস্থ আশ্রম: সমাজ ও সমাজের মানুষের কল্যাণে কাজ করা।
- সন্ন্যাস আশ্রম: আত্মিক উন্নতি এবং মানবজাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা।
এই ধাপগুলো আমাদের শিখিয়ে দেয় যে জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই সমাজের প্রতি কিছু না কিছু দায়িত্ব রয়েছে।
জীবজগতের প্রতি দায়িত্ব
সনাতন ধর্মে কেবল মানুষের প্রতি নয়, জীবজগতের প্রতিটি প্রাণীর প্রতিও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।
“অহিংসা পরমো ধর্মঃ।”
(অর্থাৎ অহিংসা বা কাউকে কষ্ট না দেওয়া পরম ধর্ম।)
আমাদের উচিত, পশুপাখিদের প্রতি দয়ালু হওয়া। তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা আমাদের মানসিক ও আত্মিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।
দায়িত্ব পালনের সুফল
আমরা যদি আমাদের সামাজিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি, তার ফলও তেমনই ইতিবাচক হয়। পরিবারে শান্তি আসে, সমাজে সম্প্রীতি বজায় থাকে এবং প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষা করে। আমাদের কর্মফল আমাদের জীবনে ফিরে আসে, এই বিশ্বাস সনাতন ধর্মের অন্যতম ভিত্তি।
“যথা কর্ম তথা ফল।”
(অর্থাৎ যেমন কর্ম করো, তেমনই ফল পাবে।)
একটি প্রশ্ন আমাদের জন্য
সনাতন ধর্ম আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দেয়। সমাজ, প্রকৃতি, পরিবার এবং সমগ্র জীবজগতের প্রতি আমাদের দায়িত্ব কখনও শেষ হয় না। তাহলে আজ প্রশ্ন হলো—আপনি কীভাবে আপনার দায়িত্ব পালন করছেন?
আমাদের সবার উচিত প্রতিদিন অন্তত একটি ভালো কাজ করা, যা সমাজ এবং প্রকৃতির উপকারে আসবে। শ্রীকৃষ্ণের সেই বাণী মনে রাখুন—
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
(অর্থাৎ তোমার কাজ করে যাও, ফলের চিন্তা করো না।)
আসুন, আমরা সকলে মিলে সমাজ এবং প্রকৃতিকে সুন্দর করে তুলি এবং সনাতন ধর্মের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবনকে সমৃদ্ধ করি।