সমবায় ব্যবস্থার প্রতি সনাতন ধর্মের মনোভাব কী?

সনাতন ধর্ম, যা আমাদের প্রাচীনতম জীবনদর্শন, জীবনের প্রতিটি দিককে গভীরভাবে আলোচনার মাধ্যমে আলোকিত করেছে। জীবনের অর্থ থেকে শুরু করে সমাজ গঠনের নিয়ম পর্যন্ত, সনাতন ধর্মে প্রতিটি বিষয়কে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যা আমাদের শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য সহায়ক। এই প্রসঙ্গে সমবায় ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। আপনি কি জানেন, সনাতন ধর্মে সমবায়ের ধারণা বহু প্রাচীন? আমাদের শাস্ত্র এবং পুরাণে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে সমবায়মূলক কাজের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। চলুন, সনাতন ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে সমবায় ব্যবস্থার গুরুত্বকে একটু গভীরভাবে বুঝি।

সমবায় ব্যবস্থার মূল ধারণা

সমবায় ব্যবস্থা বলতে বোঝানো হয় এমন একটি পদ্ধতি যেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী একত্রে কাজ করে একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জন করে। এটি শুধুমাত্র আর্থিক উন্নতির জন্য নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক উন্নয়নের জন্যও কার্যকর। সনাতন ধর্মে এই ধারণার শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত।

ঋগ্বেদের নির্দেশনা: “সহ নাভবতু সহ nau bhunaktu। সহবীর্যং করবাবহৈ।” (ঋগ্বেদ ১০.১৯০.১)

এই মন্ত্রটি আমাদের একত্রে কাজ করার এবং একে অপরের সাফল্যে আনন্দিত হওয়ার নির্দেশ দেয়। এটি আমাদের শেখায় যে, সমাজের প্রত্যেকটি সদস্যের মধ্যে সহযোগিতা ও একতার মনোভাব থাকা উচিত।

সমবায়ের উদাহরণ সনাতন ধর্মে

 গোবর্ধন পর্বতের লীলা

আপনার কি মনে আছে কৃষ্ণ যখন গোবর্ধন পর্বত উত্তোলন করেছিলেন? কৃষ্ণ একা এই কাজ করেননি; পুরো বৃন্দাবনবাসী একত্রে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। এই লীলায় আমরা দেখতে পাই, একত্রে কাজ করার শক্তি এবং একতা কীভাবে বিপদ মোকাবিলা করতে পারে। কৃষ্ণ বলেছিলেন, “যে কাজ একা সম্ভব নয়, তা একত্রে করলে সহজ হয়ে যায়।”

গুরুকুল পদ্ধতি

গুরুকুল ছিল সমবায় শিক্ষার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। শিক্ষার্থীরা একত্রে বসবাস করত, শিখত এবং নিজেদের জীবনের জন্য প্রস্তুত করত। এখানে শিষ্যরা একে অপরকে সাহায্য করত, যা তাদের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলত।

 মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডবের একতা

মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে যে একতা ছিল, তা সমবায়ের একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। প্রতিটি সদস্যের নিজস্ব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, তারা একত্রে কাজ করত এবং নিজেদের সাফল্য ভাগ করে নিত। দ্রৌপদীর সভায় কৃষ্ণ বলেন, “যেখানে একতা, সেখানে দেবতারা বাস করেন।”

সমবায় ব্যবস্থার দর্শন সনাতন ধর্মে

সনাতন ধর্মে সমবায়ের মূল কথা হল “সর্বজন হিতায়, সর্বজন সুখায়।” সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের মধ্যে সহযোগিতা ও পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি থাকা উচিত।

ভগবদ্ গীতার শিক্ষা: “লোকসংগ্রহার্থমেবাপি সংস্পন্দিতং কর্তব্যম।” (ভগবদ্ গীতা ৩.২০)

গীতার এই শ্লোকটি আমাদের শেখায় যে, সমাজের মঙ্গল সাধনের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে সমষ্টিগত কল্যাণে কাজ করা সনাতন ধর্মের অন্যতম শিক্ষা।

আধুনিক জীবনে সনাতন ধর্মের সমবায় শিক্ষা

আজকের যুগে, যেখানে সমাজ ক্রমাগত বিভাজিত হচ্ছে, সনাতন ধর্মের এই সমবায় দর্শন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।

 কৃষি এবং গ্রামীণ উন্নয়ন

ভারতের গ্রামাঞ্চলে সমবায় ব্যবস্থার প্রচলন খুবই প্রয়োজন। কৃষিক্ষেত্রে ছোট কৃষকদের একত্রে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা সনাতন ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী সমাজের অগ্রগতিতে সহায়ক হতে পারে। যেমন মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “গ্রামের উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নতি অসম্ভব।”

 আধুনিক শিল্প ও ব্যবসা

যদি ব্যবসার ক্ষেত্রেও সমবায়ের ধারণা প্রয়োগ করা যায়, তাহলে ব্যবসা শুধুমাত্র লাভজনকই হবে না, বরং মানবকল্যাণের জন্যও কাজ করবে।

 পরিবেশ রক্ষা

সনাতন ধর্মে পরিবেশকে মা’রূপে বিবেচনা করা হয়েছে। যদি আমরা একত্রে কাজ করি, তাহলে পরিবেশ রক্ষার কাজ আরও কার্যকর হবে।

সমবায় ব্যবস্থার আধ্যাত্মিক দিক

সমবায় ব্যবস্থা শুধুমাত্র একটি সামাজিক বা অর্থনৈতিক ধারণা নয়, এটি আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমরা একত্রে কাজ করি, তখন আমরা নিজের স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে সমষ্টির কল্যাণে মনোনিবেশ করি। এটি আমাদের অহংকার কমাতে এবং একতার আনন্দ অনুভব করতে সাহায্য করে।

উপনিষদের বাণী: “সহনা ভবতু। সহনৌ ভুনক্তু। সহবীর্যং করবাবহৈ।” (উপনিষদ)

এই মন্ত্রটি স্পষ্টভাবে বলে যে, একত্রে কাজ করা এবং একে অপরকে সহায়তা করা আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য।

আমাদের পথ কী?

সমবায় ব্যবস্থা শুধুমাত্র সমাজের উন্নয়নের জন্য নয়, ব্যক্তিগত উন্নতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সনাতন ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী, আমরা যদি একত্রে কাজ করি এবং একে অপরকে সাহায্য করি, তাহলে আমরা কেবলমাত্র একটি সুখী সমাজ গড়তে পারব না, বরং আধ্যাত্মিক উন্নতিও অর্জন করতে পারব। তাই, আজকের দিনে আপনার এবং আমার প্রশ্ন হল—আমরা কি একত্রে কাজ করতে প্রস্তুত? আমরা কি সনাতন ধর্মের এই শিক্ষাকে আমাদের জীবনে গ্রহণ করতে পারি?

“যেখানে একতা, সেখানেই শক্তি। যেখানে শক্তি, সেখানেই ঈশ্বর।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top