আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ধাপে সনাতন ধর্ম এমন কিছু আদর্শ প্রদান করে, যা জীবনকে উন্নত করতে এবং সমাজে নিজের ভূমিকা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। কর্মসংস্থান, অর্থাৎ জীবিকা অর্জনের প্রক্রিয়া, সনাতন ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। কর্মই ধর্ম এবং কর্মই জীবন—এই মন্ত্রকে অনুসরণ করে আমাদের জীবনে সঠিক দিশা নির্ধারণ করা সম্ভব। আজ আমি আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করব, কীভাবে সনাতন ধর্ম কর্মসংস্থানের গুরুত্বকে ব্যাখ্যা করে।
কর্মই ধর্মের মূল ভিত্তি
সনাতন ধর্ম বলে যে, কর্ম ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে (কর্মযোগ) শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
“নিহিতং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।”
(তোমার নির্ধারিত কর্ম সম্পাদন কর, কারণ কর্মের চেয়ে অকর্ম ভালো নয়।)
এই শ্লোক আমাদের শেখায় যে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মই প্রধান। কর্মসংস্থান শুধু জীবিকার মাধ্যম নয়; এটি আপনার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যও। আপনি যেই পেশাতেই থাকুন না কেন, আপনার পেশার মধ্য দিয়েই সমাজে এবং পৃথিবীতে আপনার অবদান রাখতে হবে।
কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জীবনের ভারসাম্য
আমরা সবাই জানি যে জীবন শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রাপ্তির জন্য নয়, সমাজ এবং পরিবারের দায়িত্বও আমাদের পালন করতে হয়। কর্মসংস্থান এই ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ, কৃষকরা তাদের শ্রমের মাধ্যমে সমাজের খাদ্য চাহিদা মেটান। একজন ডাক্তার রোগীদের সেবা দেন, একজন শিক্ষক জ্ঞানের আলো বিতরণ করেন। এভাবেই প্রতিটি পেশা সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সনাতন ধর্ম বলে:
“যজ্ঞার্থাত্কর্মণোন্যত্র লোকোয়ং কর্মবন্ধনঃ।”
(কর্ম সেই যজ্ঞের মতো, যা জীবনের প্রতিটি দিককে পূর্ণ করে।)
আপনার কর্ম যদি সঠিক উদ্দেশ্যে এবং মনোযোগ দিয়ে করা হয়, তবে সেটি শুধু আপনার নিজের নয়, সমাজের মঙ্গলও বয়ে আনে।
কর্মে শ্রেষ্ঠত্বের সাধনা
সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায় যে, আমরা যাই করি না কেন, সেটি নিখুঁত এবং আন্তরিকভাবে করতে হবে।
ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে:
“যোগঃ কর্মসু কাউশলম।”
(কর্মে নিপুণতাই যোগ।)
এটি আপনার জীবিকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদি আপনি আপনার কাজে নিষ্ঠা এবং দক্ষতা প্রদর্শন করেন, তাহলে আপনি শুধু সফল হবেন না, বরং আপনার কাজটি আপনার জীবনের উদ্দেশ্যেও পরিণত হবে।
একজন স্থপতির কথা ভাবুন, যিনি নিজের দক্ষতা এবং সৃজনশীলতার মাধ্যমে একটি সুন্দর স্থাপত্য তৈরি করেন। তিনি শুধুমাত্র নিজের জীবিকার জন্য কাজ করেন না, বরং সমাজের সৌন্দর্য বাড়াতেও অবদান রাখেন। এটাই কর্মের যোগ।
কর্মের মাধ্যমেই সৃষ্টির প্রতি অবদান
সনাতন ধর্ম বিশ্বাস করে যে, আমরা প্রত্যেকেই এই সৃষ্টির একটি অংশ এবং আমাদের কর্মের মাধ্যমে আমরা সৃষ্টির প্রতি আমাদের ঋণ শোধ করি।
উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যবসায়ী যখন সৎ উপায়ে ব্যবসা পরিচালনা করেন, তিনি শুধু নিজের লাভের জন্য কাজ করেন না, বরং গ্রাহকদের প্রয়োজন মেটানোর জন্যও কাজ করেন। একইভাবে, একজন গৃহিণী তার পরিবারের জন্য প্রতিদিন যেভাবে কাজ করেন, সেটিও কর্মের একটি রূপ। এভাবে কর্মের মাধ্যমে আমরা একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকি।
কর্মে আত্মত্যাগের গুরুত্ব
সনাতন ধর্ম কর্মে আত্মত্যাগের উপরও জোর দেয়। কর্মের ফলাফলের প্রতি লোভ না রেখে, কেবল কর্তব্য পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
(তোমার অধিকার শুধু কর্মে, ফলাফলে নয়।)
যদি আপনি একটি পেশায় নিযুক্ত থাকেন এবং সেটি আপনার জন্য আনন্দদায়ক না হয়, তবুও আপনাকে সেটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে। এই মানসিকতা আপনাকে জীবনে শান্তি এনে দেবে।
কর্মসংস্থানের জন্য কয়েকটি উদাহরণ
- শিক্ষকতা: একজন শিক্ষক যখন শিক্ষাদান করেন, তিনি শুধু ছাত্রদের ভবিষ্যৎ তৈরি করেন না, বরং তিনি একটি জাতির ভিত্তি গড়েন।
- কৃষি: কৃষকরা তাদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সমাজের খাদ্য চাহিদা পূরণ করেন। এটি শুধু তাদের কর্ম নয়, এটি একটি যজ্ঞ।
- স্বাস্থ্যসেবা: ডাক্তার এবং নার্সরা তাদের কর্মের মাধ্যমে অসুস্থদের আরোগ্য দেন। তারা মানবতার প্রতি নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন।
কর্মসংস্থানের প্রতি সনাতন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি
সনাতন ধর্ম কর্মসংস্থানকে কেবল জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে দেখে না, এটি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রতিটি কাজকে যজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এতে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টির অংশ হন।
অতএব, আপনার পেশা যাই হোক না কেন, সেটিকে গুরুত্ব দিন এবং মনোযোগ সহকারে পালন করুন। কারণ কর্মই ধর্ম এবং কর্মই জীবনের মূল সোপান।
উপসংহার
জীবনে কর্মের গুরুত্ব কখনোই উপেক্ষা করা উচিত নয়। কর্মই আমাদের জীবনকে সার্থক করে এবং সমাজে আমাদের অবদানকে মূল্যবান করে তোলে। আমি আশা করি, সনাতন ধর্মের এই শিক্ষা আপনার কর্মজীবনে নতুন দিশা আনবে।