আমরা সবার জীবনে একটি বড় ভূমিকা পালনকারী বিষয় হলো পরিবার। পরিবার বলতে আমি শুধু জন্মদাতা মা-বাবাকে বুঝাচ্ছি না, বরং সেই পরিবেশটাও যে আমাদের মন, চরিত্র এবং জীবনদৃষ্টিকোণ তৈরি করে, সেটাও। সনাতন ধর্ম, যা একে একে প্রায় পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো, আমাদের সন্তানের লালনপালন ও তাদের আদর্শে গড়ে তোলার জন্য এক অনন্য পথপ্রদর্শক। সনাতন ধর্মে সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালিত করা, তাদের নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করা এবং চরিত্র গঠন করা—এগুলোই মূল লক্ষ্য।
আমার বিশ্বাস, সনাতন ধর্মে সন্তান লালনপালনের যে নীতি রয়েছে, তা আমাদের শুধু ব্যক্তি জীবন নয়, বরং সমাজ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের দিকে পরিচালিত করে। চলুন, আমরা একটু গভীরভাবে দেখি, সনাতন ধর্মে সন্তানদের কীভাবে সঠিকভাবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ
সনাতন ধর্মে একজন বাবা-মায়ের দায়িত্ব শুধুমাত্র সন্তানের শারীরিক ও মানসিক যত্ন নেওয়া নয়, বরং তাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নতি সাধনও। প্রথমত, সন্তানদের শিখানো হয় জীবনকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে।
“যেন পিতা, তেমন পুত্র।” (ব্রহ্মপুরাণ) এই উক্তিটি সনাতন ধর্মের মূল সত্য। সন্তান তাদের পিতামাতার আদর্শ অনুসরণ করে এবং পিতামাতা তাদের জীবনে একটি শক্তিশালী আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে সন্তানের মধ্যে। সনাতন ধর্মের বহু গ্রন্থে বলা হয়েছে, সন্তানদের দৈনন্দিন জীবনে ঈশ্বরের স্মরণ করতে উৎসাহিত করতে হবে। প্রতিদিন প্রার্থনা, তন্ত্র-মন্ত্র বা পবিত্র ধর্মীয় গান গাওয়ার মাধ্যমে সন্তানের মধ্যে একটি ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত। এই ধরনের আধ্যাত্মিক শিক্ষা, সন্তানকে জীবনের প্রতিটি ধাপে সাহসী, ধার্মিক এবং সৎ হতে সাহায্য করবে।
শিষ্টাচার ও নৈতিকতা
সনাতন ধর্মে সন্তান লালনপালনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিষ্টাচার এবং নৈতিকতা। যেসব অভ্যেস সন্তানের মধ্যে সঠিকভাবে গড়ে তোলা হয়, তা তার চরিত্রের ভিত তৈরি করে।
“ধর্মে চিরকাল থাকে, অপরাধে থাকে নষ্টি।” (মনুস্মৃতি) আমরা জানি, সন্তান যখন ছোট থাকে, তখন তার চরিত্র গঠন করা অনেকটাই সহজ। যদি তাকে ছোটবেলা থেকেই শিষ্টাচার, সততা, সহানুভূতি ও দায়িত্বশীলতা শেখানো হয়, তবে সে বড় হয়ে সেই নীতিগুলো জীবনমুখীভাবে অনুসরণ করতে পারবে। সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, সন্তানের মধ্যে সদগুণ শিখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সাধারণ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়:
- বাচ্চাদের মাঝে ছোট থেকে সাহায্য করার অভ্যাস গড়ে তোলা। এটি একটি বড় নৈতিক গুণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সনাতন ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী আত্ম-উন্নতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
- ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করানো, যাতে তারা নৈতিক দায়িত্ববোধ ও আধ্যাত্মিক পরিচিতি লাভ করে।
এই অভ্যাসগুলি তাদের এক ধরনের আধ্যাত্মিক শক্তি ও শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি প্রদান করবে, যা তাদের জীবনে সবসময় চলবে।
শৃঙ্খলা ও শিক্ষা
সনাতন ধর্মে শৃঙ্খলা এবং শিক্ষা সবসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে। আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে শৃঙ্খলার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাবা-মাকে সন্তানের জন্য আদর্শ হতে হবে, যেন তারা তাদের জীবনে শৃঙ্খলা, সময়-সুচী, অধ্যবসায় এবং নিষ্ঠা রক্ষা করতে পারে।
“উচ্চচিন্তা এবং সুসম্বদ্ধ কাজই জীবনের সঠিক পথ।” (গীতা) এই ধরনের মূল্যবোধ, যা ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের মধ্যে তৈরি করা হয়, তাদের জীবনে সফলতার চাবিকাঠি হতে পারে। শৃঙ্খলা মানে শুধু সময়ের প্রতি শ্রদ্ধা নয়, বরং নিজের অন্তর্দৃষ্টি, মনোবল ও উদ্দেশ্যের প্রতি প্রতিশ্রুতি। সনাতন ধর্মে শিক্ষা এবং শৃঙ্খলার অনুশীলন সন্তানের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো গভীর ও বাস্তববাদী করে তোলে। একটি সুষম জীবনযাপন, সন্তানকে আত্মবিশ্বাসী, কার্যকরী এবং দায়িত্বশীল করে তোলে।
স্নেহ ও ভালোবাসা
একটি সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠা করার জন্য যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো স্নেহ ও ভালোবাসা। সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, যতটা প্রয়োজন শাস্তি, ততটাই প্রয়োজন স্নেহ। সন্তানকে যদি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা দিয়ে বড় করা যায়, তবে সে কখনও অসন্তুষ্ট বা হতাশ হবে না।
“শিশু মানে ঈশ্বরের প্রতিফলন।” (ব্রহ্মপুরাণ) এই উক্তিটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সন্তানদের প্রতি আমাদের আচরণ যেন সদা সদয়, সহানুভূতিশীল এবং নিরাপদ হয়। তাদের স্বাভাবিক ভুলগুলো প্রশমিত করে তাদের শেখানো উচিত। সন্তানকে ভালোবাসা, প্রশংসা ও প্রেরণা দেওয়া হলে তারা সঠিকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
উদাহরণ সৃষ্টি করা
সবচেয়ে বড় শিক্ষক কিন্তু পিতা-মাতা নিজেই। সন্তান তার পিতামাতার কথার চেয়ে তাদের কাজের দিকে বেশি তাকায়। এক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে নিজের আচরণে একটি উত্তম উদাহরণ স্থাপন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের সংস্কৃতিতে অতিথি দেবो ভবা (অতিথি ঈশ্বর সমান) একটি মৌলিক ধারণা। যদি পিতামাতা এই ধারণা বাস্তবায়িত করেন, তাহলে সন্তানও এই নীতি অনুসরণ করবে।
এছাড়া, কখনও আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে সন্তানকে শিক্ষা দেওয়া যায়। যেমন, নিজে সততার সঙ্গে ব্যবসা বা কাজ করা, কখনও মিথ্যা না বলা বা অন্যায়কে বিরোধিতা করা—এগুলোই সন্তানের মধ্যে ধার্মিক মূল্যবোধ তৈরি করে।
উপসংহার
আমাদের জীবনে সন্তানরা কেবল আমাদের উত্তরসূরি নয়, তারা সমাজের ভবিষ্যত, আমাদের মূল্যবোধের উত্তরাধিকারী। সনাতন ধর্মে সন্তান লালনপালনের নীতিগুলি শুধুমাত্র তাদের চারিত্রিক গঠনেই নয়, বরং জীবনের সব দিকেই তাদের সুখী, সৎ এবং উন্নত করার উদ্দেশ্য রাখে।
কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আপনার সন্তান যদি আজকে আপনি যে নীতিগুলি তাকে শিখাচ্ছেন, তা আগামীতে সমাজের উন্নতির জন্য অবদান রাখে, তবে কি আপনি সন্তুষ্ট হবেন? এই নীতিগুলি আমাদের নিত্যদিনের জীবনে কাজ করবে, যদি আমরা তা অনুসরণ করি—তবে সন্তানের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা কতটা পূর্ণাঙ্গ?
সনাতন ধর্মের মূল্যবোধের মধ্যে গভীর চিন্তা রয়েছে, যা শুধু ধর্মীয় জ্ঞানই নয়, একটি সুন্দর, সৎ ও দায়িত্বশীল সমাজ গড়ে তুলতে পারে।