সনাতন ধর্মে ভোগবাদের (consumerism) বিরুদ্ধে কোন নীতি আছে?

আমরা আজকের আধুনিক পৃথিবীতে বসবাস করছি যেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পণ্য, অফার, এবং প্রচারণা আমাদের দিকে ধেয়ে আসে। ক্রমবর্ধমান ভোগবাদী মনোভাব আমাদের জীবনকে অভ্যস্ত করে ফেলছে। সবকিছুই যেন এখন পরিমাপযোগ্য — আরও বেশি, আরও ভালো, আরও দ্রুত। তবে, সনাতন ধর্ম কি এর বিরুদ্ধে কোনো নীতি বা পরামর্শ প্রদান করেছে? আপনার যদি সনাতন ধর্মের আদর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন করতে আগ্রহী হন, তাহলে আমি আপনাকে বলি, হ্যাঁ, সনাতন ধর্ম ভোগবাদিতা এবং ভোগের অতিরিক্ত প্রবণতার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট নীতিমালা এবং দিকনির্দেশনা প্রদান করে।

 ভোগবাদিতা কি?

ভোগবাদিতা বা consumerism একধরনের জীবনধারা যেখানে মানুষের প্রধান লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হলো পণ্য এবং সেবা ক্রয় ও ভোগ করা। বর্তমান সমাজে, আমরা প্রায়ই দেখে থাকি যে মানুষ অর্থ উপার্জন করে শুধু খরচ করতে এবং উপভোগ করতে, তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বা সমাজের মধ্যে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করার জন্য। কিন্তু এই প্রবণতা কখনো কখনো অতিরিক্ত হয়ে ওঠে এবং ব্যক্তি নিজেকে এই চক্রে আটকে ফেলে।

ভোগবাদী সমাজে, আমরা যে সময়ে আছি, তা সনাতন ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা সঠিক তা একবার ভেবে দেখুন। সনাতন ধর্ম কি আমাদের এই প্রবণতা সম্পর্কে কিছু বলেছে?

 সনাতন ধর্মের মূল নীতিমালা: সুখের প্রকৃত ধারণা

সনাতন ধর্মে সুখের মূল উৎস ভোগে নয়, বরং আত্মানন্দ, ত্যাগ এবং সত্য অনুসন্ধানে। ভোগের চেয়ে যে শান্তি এবং সন্তুষ্টি মানুষের হৃদয়ে বিরাজ করতে পারে, তা কেবলমাত্র অন্তর্দৃষ্টি, আত্মপরিচয় এবং আধ্যাত্মিক চর্চায় পাওয়া যায়।

“যদি তুমি কোনো কিছু চাও, তবে তা অবশ্যই পরিশ্রম ও সৎ পথে অর্জন করো, অন্যথায় তা ক্ষতিকর হবে।” — বগবদ গীতা

এটি আমাদের শিখায় যে, ভোগের প্রতি অদৃশ্য আকর্ষণ আমাদের অস্থির করতে পারে। কিন্তু যদি আমরা পরিশ্রম ও সৎ পথ অনুসরণ করি, তবে আমরা প্রকৃত শান্তি লাভ করতে পারি। আর এর জন্য আমাদের ভোগের প্রতি অযথা আকর্ষণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

 সনাতন ধর্মে ভোগবাদে বিরোধিতা

“যে ব্যক্তি অন্যদের দান করে, সে প্রকৃত সুখী।” — মহাভারত

সনাতন ধর্মের বাণী অনুযায়ী, প্রকৃত সুখ আসলে একে অপরের সঙ্গে ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং সহযোগিতা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে নিহিত। স্নেহ, দয়া এবং দানের মাধ্যমে মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটে। ভোগবাদী মনোভাব শুধু নিজের সুখের জন্য সমস্ত কিছু চাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করে, কিন্তু এটি আত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে খালি এবং ক্ষতিকর।

সনাতন ধর্মে ত্যাগের গুরুত্ব অনেক বেশি। একে অপরকে সাহায্য করতে পারলে, সেটাই প্রকৃত সুখের পথ। আমাদের ভোগের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ আমাদের থেকে এই মানবিক গুণাবলির বিকাশ নষ্ট করে দিতে পারে।

“প্রকৃত সুখ একমাত্র ত্যাগে নিহিত, না যে শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে চিন্তা করবে।” — উপনিষদ

 সনাতন ধর্মে উপহার, ত্যাগ, এবং আত্মজ্ঞান

প্রতিটি মানুষই জীবনে সুখের পেছনে ছুটে চলে। কিন্তু সনাতন ধর্ম জানায়, আমাদের আনন্দ, শান্তি এবং গতি কেবলমাত্র ভোগের মধ্যেই নয়। আত্মজ্ঞান, সাধনা এবং আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের মাধ্যমে আমরা যে সুখ পেতে পারি, তা পৃথিবীর সমস্ত ভোগের চেয়ে অনেক বেশি গভীর এবং স্থায়ী।

“শুধুমাত্র নিজেকে চিনতে পারলেই, তুমি প্রকৃত সুখ পাবে।” — ব্রহ্মা সুত্র

এই বাণী আমাদের শিখায়, যদি আমরা আমাদের আত্মার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি, তবে পৃথিবীর যে কোনো ভোগের প্রতি আকর্ষণ আমাদের কাছে অর্থহীন হয়ে যাবে।

 সনাতন ধর্মে ভোগের পরিণতি

আমরা যদি নিজের জীবনকে শুধুমাত্র ভোগের দিকে নিয়মিত ঝুঁকে রাখি, তবে এক সময় আমাদের জীবনে মানসিক অশান্তি এবং দুঃখ আসবে। সেই দুঃখ আসবে কারণ আমাদের চাহিদাগুলি কখনও শেষ হবে না। ভোগের পরিধি এতটাই বিস্তৃত, যে আমরা চাইলে কখনোই এর অবসান ঘটাতে পারব না।

“আত্মার প্রকৃত সন্তুষ্টি বাহ্যিক উপকরণ থেকে আসে না।” — বগবদ গীতা

ভোগের মধ্যে সঠিক সীমা বজায় রাখতে না পারলে, তা আমাদের জীবনে অশান্তি এবং বিরক্তি সৃষ্টি করবে। সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায় যে, আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হলে, আমাদের ভোগের প্রতি আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে।

 ভোগের থেকে মুক্তি: সনাতন ধর্মের পথ

সনাতন ধর্ম আমাদের ভোগের প্রতি নির্দিষ্ট নিয়ম এবং পরামর্শ দিয়েছে, যাতে আমরা একটি সঠিক পথে চলতে পারি। আত্মজ্ঞান, সাধনা এবং দানের মধ্য দিয়ে আমরা ভোগের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করতে পারি এবং সেই সঙ্গে আমরা আরও শান্ত এবং স্থির জীবন পেতে পারি।

আমরা যখন ভোগের দিকে মনোযোগ কমিয়ে, নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে নজর দিব, তখন প্রকৃত শান্তি এবং সুখ আমাদের জীবনে আসবে। সনাতন ধর্ম আমাদের শিখায় যে, প্রকৃত সুখ কোনো বাহ্যিক বস্তু থেকে নয়, বরং অন্তর থেকে আসে। আমাদের আত্মাকে চিনতে হবে, তার পরেই আমরা বুঝতে পারব যে, আসল সুখ কোথায়।

উপসংহার

এখন, আপনি কি ভোগের প্রতি আকৃষ্ট হতে চান, নাকি নিজের আত্মাকে জানার পথে এগিয়ে যেতে চান? সনাতন ধর্মের প্রজ্ঞা এবং নীতিগুলি আমাদের শিখায়, কীভাবে আমরা শান্তিপূর্ণ এবং সুখী জীবনযাপন করতে পারি। তবে, একে শুধু পাঠ্য না করে, বাস্তব জীবনে অবলম্বন করতে হবে। ভোগের মোহ থেকে মুক্তি পেয়ে, আপনার আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে চলুন এবং দেখুন কেমন ভাবে আপনার জীবন বদলে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top