সনাতন ধর্মে বিয়ের আচার ও রীতির পেছনের তাৎপর্য কী?

সনাতন ধর্মে বিয়ে শুধু দুটি মানুষের মিলন নয়; এটি দুই পরিবারের মধ্যে পবিত্র বন্ধন ও সামাজিক দায়বদ্ধতার সূচনা। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে বিয়েকে ‘ধর্মের ভিত্তি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, কেন এই আচারগুলো এত গুরুত্ব পায়? চলুন আজ আমি আপনাকে বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানের পিছনের গভীর তাৎপর্য বুঝিয়ে বলি।

বিয়ের আচার: শাস্ত্রীয় ভিত্তি

সনাতন ধর্মে বিয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো ‘ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ’—এই চার পুরুষার্থের মধ্যে সুষমতা আনা। বেদের মতে, বিয়ে মানে দুটি আত্মার মিলন, যা একসঙ্গে জীবনের চারটি স্তম্ভকে ধরে রাখে।

 সপ্তপদী

বিয়ের মন্ত্র উচ্চারণ করে সপ্তপদী (সাত পা) পর্বটি সম্পন্ন হয়। আপনি জানেন কি, এই সাতটি পদক্ষেপ প্রতীকী? এগুলো জীবনের সাতটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে বোঝায়—অন্ন, শক্তি, ঐশ্বর্য, সুখ, সন্তান, ঋতু এবং বন্ধুত্ব। ঋগ্বেদের একটি শ্লোক বলে:

“সখা सप्तপদা ভব।”
(আমরা এই সাত পা একসঙ্গে হেঁটে বন্ধু হলাম।)

এটি বোঝায়, বিয়ে শুধু দাম্পত্য সম্পর্ক নয়; এটি বন্ধুত্ব এবং সমতার বন্ধন।

বাস্তব উদাহরণ: আপনার জীবনের প্রয়োগ

আমাদের জীবনে বিয়ের আচার কিভাবে সাহায্য করে? ধরুন, একজন দম্পতি একসঙ্গে সংসার শুরু করছে। তাদের জন্য বিয়ের প্রতিটি মন্ত্র ও আচার ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রতিজ্ঞা হিসেবে কাজ করে। যেমন—“আমরা সবসময় একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব” এই ভাবনা দাম্পত্য সম্পর্ককে মজবুত করে।

হোম বা অগ্নিসাক্ষী

বিয়ের সময় অগ্নিকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করা হয়। অগ্নি এখানে পবিত্রতার প্রতীক। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দাম্পত্য সম্পর্কের প্রতিটি কাজ সততা এবং পবিত্রতার সঙ্গে করা উচিত।

কন্যাদান

কন্যাদান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আচার। এটি বোঝায়, বাবা-মা তাদের মেয়েকে স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে একটি নতুন জীবনের জন্য আশীর্বাদ করেন। কন্যাদানের সময় যে মন্ত্র বলা হয়:

“ইহ নারী তে রক্ষিতা ভব।”
(এই নারীকে তুমি সর্বদা রক্ষা করবে।)

এটি দাম্পত্য সম্পর্কের দায়িত্ব এবং যত্নের কথা বলে।

সামাজিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

আপনি কি জানেন, বিয়ের আচার শুধু ব্যক্তিগত জীবনের জন্য নয়, এটি সমাজের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ? বিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে ঐক্য আনে এবং সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। শাস্ত্র মতে, একে অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালন না করলে সমাজ অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।

মঙ্গলসূত্র

মঙ্গলসূত্র শুধু একটি অলংকার নয়; এটি স্ত্রীর জীবনে স্বামীর দীর্ঘায়ুর প্রতীক। এটি দাম্পত্যের পবিত্রতা এবং স্ত্রীর প্রতিজ্ঞার স্মারক।

ধর্মীয় দিক: মোক্ষের পথে সঙ্গী

সনাতন ধর্মে বিয়ে শুধু দৈহিক বা পার্থিব বিষয় নয়; এটি মোক্ষের পথে একটি সঙ্গী খোঁজার প্রক্রিয়া। যজুর্বেদের একটি শ্লোক বলে:

“দম্পত্যে মোক্ষস্য পথঃ।”
(দম্পতি একসঙ্গে মোক্ষের পথে অগ্রসর হয়।)

এই আচারগুলো আমাদের শেখায়, কিভাবে একজন সঙ্গীর সঙ্গে জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ করা যায়।

আপনার উপলব্ধি

বিয়ের আচারগুলো হয়তো আজকের যুগে অনেকে জটিল বা পুরোনো মনে করেন। তবে আপনি যদি এগুলোর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক তাৎপর্য বুঝতে পারেন, তবে দেখবেন এগুলো আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

আপনার মতে, এই আচারগুলো কি আজকের সমাজে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে? নাকি এগুলো কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে? আপনার উত্তরই হতে পারে সনাতন ধর্মের এই পবিত্র আচারগুলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপনের এক নতুন পথ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top