প্রেম, এই শব্দটি ছোট হলেও এর গভীরতা অসীম। সনাতন ধর্মে প্রেমের গুরুত্ব শুধু মানবজীবনে নয়, এই সৃষ্টির প্রতিটি কণায় স্পষ্ট। আজ আমি এবং আপনি মিলে আলোচনা করব সনাতন ধর্মে প্রেমের প্রকৃত অর্থ এবং এটি কীভাবে আমাদের জীবনকে আলোকিত করে।
প্রেমের প্রকৃতি: স্বার্থহীনতা এবং সমর্পণ
সনাতন ধর্ম প্রেমকে স্বার্থহীনতার প্রতীক হিসেবে দেখায়। প্রেম মানে শুধু কোনো ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ নয়, এটি হল সৃষ্টিকর্তার প্রতি, জীবের প্রতি, এবং প্রকৃতির প্রতি আমাদের সমর্পণ। গীতার ১২.১৩-১৪ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“অদ্বেষ্তা সর্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এভ চ।
নির্মমঃ নিরহংকারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী।।”
অর্থাৎ, প্রকৃত ভক্ত সেই, যিনি সর্বজীবের প্রতি মৈত্রী ও করুণা অনুভব করেন, যিনি অহংকারশূন্য এবং অন্যের সুখ-দুঃখকে নিজের মতো অনুভব করেন।
এই শ্লোক থেকে বোঝা যায়, প্রেমের মূল ভিত্তি হল মৈত্রী, ক্ষমা, এবং পরস্পরের প্রতি সমান মনোভাব। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এই নীতিগুলো মেনে চললে আমাদের সম্পর্ক কত সুন্দর হতে পারে?
রাধাকৃষ্ণের প্রেম: ঈশ্বরের প্রতি অনন্ত সমর্পণ
রাধা-কৃষ্ণের প্রেম সনাতন ধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এই প্রেমে শারীরিক আকর্ষণের কোনো স্থান নেই; এটি হল চিরন্তন আত্মিক বন্ধনের প্রতীক। রাধার প্রেম ছিল এমন এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, যেখানে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণের প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে।
আমাদের জীবনেও যদি আমরা এই রাধার মতো নিঃস্বার্থ হতে পারি, তাহলে সম্পর্কের প্রতিটি বাঁধন আরো গভীর এবং অর্থপূর্ণ হবে।
প্রেম ও করুণা: মহাত্মা গান্ধীর উদাহরণ
মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন, “প্রেম হল পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তি, এবং এটি সবকিছুকে জয় করতে পারে।” গান্ধীজির জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা দেখতে পাই প্রেম ও করুণার প্রতিফলন। তিনি কখনো নিজের শত্রুকেও ঘৃণা করেননি; বরং প্রেম এবং সহানুভূতির মাধ্যমে তাদেরকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
আপনার জীবনেও এমন উদাহরণ নিশ্চয়ই রয়েছে, যেখানে আপনি সহানুভূতির মাধ্যমে কঠিন সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন। আপনি যদি ভাবেন, তাহলে বুঝতে পারবেন, প্রতিটি সমস্যার কেন্দ্রে থাকে প্রেম ও ক্ষমার শক্তি।
প্রেমের আধুনিক প্রয়োগ
আজকের ব্যস্ত জীবনে আমরা প্রেমের প্রকৃত অর্থ ভুলে গেছি। আমরা নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার পেছনে এতটাই ছুটছি যে অন্যের অনুভূতির কথা ভাবার সময় পাচ্ছি না। কিন্তু সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায়, সত্যিকারের প্রেম মানে শুধু নেওয়া নয়, দেওয়াও।
আপনার কি মনে হয় না, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটু বেশি সহানুভূতি এবং ভালোবাসা নিয়ে এলে সমাজের চেহারা অনেকটাই বদলে যাবে?
প্রেম ও প্রকৃতি
সনাতন ধর্ম প্রকৃতির প্রতি প্রেমকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। বেদে বলা হয়েছে,
“মাতাভূমি: পুত্রোহম পৃথিব্যাঃ।”
অর্থাৎ, এই পৃথিবী আমাদের মা এবং আমরা তার সন্তান। প্রকৃতির প্রতি এই প্রেম ও যত্ন ছাড়া আমরা জীবনের প্রকৃত অর্থ কখনোই খুঁজে পাব না। আজ আপনি যদি একটি গাছ লাগান বা একটি পশুকে ভালোবাসা দেন, তাতেই আপনার মধ্যে সনাতন ধর্মের প্রেমের শিক্ষা প্রতিফলিত হবে।
প্রেম এবং আত্মজ্ঞান
গীতার আরেকটি শ্লোক (৬.২৯) উল্লেখ করা যেতে পারে:
“সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।।”
এই শ্লোকটি আমাদের শেখায়, যে ব্যক্তি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন, তিনি সর্বত্র ঈশ্বরকে দেখতে পান এবং সমস্ত জীবকে নিজের অংশ হিসেবে মনে করেন। এটি প্রকৃত প্রেমের সর্বোচ্চ রূপ।
আপনার কি মনে হয় না, এই অনুভূতি অর্জন করলে পৃথিবীর সব যুদ্ধ, হিংসা, এবং দ্বন্দ্ব বন্ধ হয়ে যাবে?
উপসংহার
সনাতন ধর্মের প্রেম মানে শুধুই আকর্ষণ নয়; এটি স্বার্থহীনতা, সমর্পণ, এবং সহানুভূতির চরম রূপ। আপনার জীবনে এই প্রেমের মূল মন্ত্রটি যদি আপনি প্রয়োগ করেন, তবে আপনি এবং আপনার চারপাশের মানুষ সবাই খুশি থাকবে।