সনাতন ধর্মে পরিবারে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানীয়। আপনি যদি ধর্মীয় দর্শনের মধ্যে ডুবে দেখেন, তবে বুঝতে পারবেন যে সনাতন ধর্ম নারীকে শুধুমাত্র পরিবার নয়, সমাজের ভিত্তি হিসেবে স্থান দিয়েছে।
নারীর গুরুত্ব: শাস্ত্রের আলোকে
“যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা” (মনু সংহিতা ৩.৫৬) – অর্থাৎ যেখানে নারীদের সম্মান করা হয়, সেখানে দেবতারা বাস করেন। এই একটি শ্লোকই বোঝায় যে সনাতন ধর্মে নারীকে কতটা উচ্চ আসনে বসানো হয়েছে। আপনি যদি পরিবারকে একটি গাছের সঙ্গে তুলনা করেন, তবে নারী সেই গাছের শিকড়। শিকড় যেমন গাছের জীবন রক্ষা করে, নারী তেমনই পরিবারকে জীবনের পথ দেখায়।
মাতা: পরিবার গঠনের মূল স্তম্ভ
সনাতন ধর্মে মা শব্দটি কেবল একটি সম্পর্ক নয়; এটি একটি দায়িত্ব, একটি ভূমিকা। একজন মা সন্তানের প্রথম গুরু। “মাতৃ দেবো ভব” – এই বাণী আপনার কাছে পরিচিত। এটি শাস্ত্রে উল্লেখিত একটি মহৎ সত্য। মা পরিবারের মধ্যে সন্তানের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি নিশ্চিত করেন। উদাহরণস্বরূপ, মা যশোদা কৃষ্ণকে যেমন ভালবাসা ও আদর্শ শিক্ষা দিয়েছিলেন, তেমনি প্রত্যেক মা তার সন্তানকে ধর্মের পথে চলার শিক্ষা দেন।
স্ত্রীর ভূমিকাঃ সঙ্গিনী ও সহধর্মিণী
গৃহস্থ আশ্রমে স্ত্রীকে বলা হয় “সহধর্মিণী”। অর্থাৎ, ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে তিনি স্বামীর সমান অংশীদার। আপনি যদি মহাভারতের দ্রৌপদীর কথা ভাবেন, তবে বুঝতে পারবেন কীভাবে একজন নারী তার পরিবারকে কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে পারে। দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের জন্য শুধু একজন স্ত্রীই নন, একজন পরামর্শদাতা এবং তাদের আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস ছিলেন।
অনুরূপভাবে, আপনার জীবনেও স্ত্রীকে একজন বন্ধু এবং সঙ্গিনী হিসেবে দেখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। “দাম্পত্য জীবন তপস্যার সমান,” এই দৃষ্টিকোণ থেকে, স্ত্রীর সঙ্গে পারস্পরিক সম্মান ও সমর্থন একটি পবিত্র সম্পর্ক তৈরি করে।
বোন ও কন্যাঃ ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা
সনাতন ধর্মে কন্যা ও বোনকেও বিশেষ সম্মান দেওয়া হয়েছে। কন্যাকে দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। “কন্যা লক্ষ্মী রূপে পূজ্যতে” – অর্থাৎ কন্যা পরিবারে সুখ, সমৃদ্ধি এবং শান্তি বয়ে আনে।
রামায়ণে আমরা দেখি সীতা নিজে কেবলমাত্র রামের সহধর্মিণীই ছিলেন না, তিনি নিজের আত্মসম্মানের প্রতীকও ছিলেন। আপনারা সীতা চরিত্র থেকে শিখতে পারেন কীভাবে একজন নারী তার সম্মান ও অধিকার বজায় রাখতে পারে।
নারীর শক্তির উদাহরণ
- গার্গী ও মৈত্রেয়ী: উপনিষদে গার্গী এবং মৈত্রেয়ীর জ্ঞানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা দেখিয়েছেন, নারীরা শুধুমাত্র গৃহস্থ নয়, আধ্যাত্মিক দিক থেকেও সমাজকে পথ দেখাতে পারেন।
- দ্রৌপদী: দ্রৌপদীর সাহস এবং ধৈর্য পরিবার রক্ষা করার একটি চমৎকার উদাহরণ।
- কুণ্ঠী: মহাভারতে কুণ্ঠী মাতৃত্বের আদর্শ প্রতীক। তার চরিত্র থেকে আপনারা শিখতে পারেন কীভাবে কঠিন পরিস্থিতিতেও একজন মা তার সন্তানদের মঙ্গল কামনা করেন।
আধুনিক জীবনে নারীর ভূমিকা
আপনারা হয়তো ভাবছেন, আজকের যুগে সনাতন ধর্মের এই আদর্শগুলো কতটা প্রাসঙ্গিক? আসলে, এগুলি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনে নারীরা পরিবারের পাশাপাশি সমাজেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তারা তাদের পারিবারিক দায়িত্ব এড়িয়ে যান। বরং সনাতন ধর্মের মূল্যবোধ তাদের এই ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
আপনারা যদি সনাতন ধর্মের শিক্ষা অনুসরণ করেন, তবে দেখতে পাবেন নারীরা কেবল ঘরের মন্দিরের প্রদীপ নন; তারা পুরো সমাজের আলোকবর্তিকা।
ধর্মীয় মূল্যবোধে নারীর অবদান
নারীর ভূমিকা কেবল শারীরিক বা মানসিক সমর্থনে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধের ধারক। একজন মা, স্ত্রী বা কন্যা ধর্মের যে শিক্ষা পরিবারের মধ্যে বিস্তার করেন, তা প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
উপসংহার
নারীরা সনাতন ধর্মে পরিবারের শিকড়, গৃহস্থের মঙ্গলদায়িনী, এবং সমাজের আলোকবর্তিকা। তাদের সম্মান না করলে আমরা ধর্মের প্রকৃত অর্থ হারিয়ে ফেলব। তাই আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই: আপনি কি আপনার জীবনে নারীদের সম্মান দিয়ে তাদের প্রকৃত স্থান দিচ্ছেন? মনে রাখবেন, সনাতন ধর্মের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হলে নারীর ভূমিকা এবং তাদের প্রতি সম্মান বুঝতে হবে।