সনাতন ধর্মে ধনীদের দায়িত্ব কী?

সনাতন ধর্মে ধনীদের কাছে একটি বিশেষ দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে, যা কেবল তাদের ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার জন্য নয়, বরং সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য। আপনার কাছে যদি ধন-সম্পদ থাকে, তাহলে সেটি শুধু আপনার জন্য নয়; এটি ঈশ্বরের প্রদত্ত একটি উপহার, যা সঠিকভাবে ব্যবহার করার দায়িত্ব আপনার। আসুন, আমরা সনাতন ধর্মের আলোকে এই বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি।

ধন এবং দায়িত্বের মধ্যে সম্পর্ক

গীতা থেকে শুরু করে উপনিষদ, সনাতন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে বারবার ধনীদের দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। ভগবদ্গীতায় (৩.১২) বলা হয়েছে:

“যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুক্তা শারীরবন্ধনাত্।
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাত্॥”

অর্থাৎ, যাঁরা যজ্ঞের পর শিষ্ট অন্ন গ্রহণ করেন, তাঁরা মুক্ত হন পাপ থেকে। কিন্তু যাঁরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে শুধুমাত্র নিজেদের জন্য রান্না করেন, তাঁরা পাপভোগী।

এই শ্লোক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সম্পদের সঠিক ব্যবহার করা হল একটি যজ্ঞ, যেখানে আপনি আপনার সম্পদকে অন্যদের কল্যাণে উৎসর্গ করেন।

ধনীদের দায়িত্ব কীভাবে পালন করবেন?

আমরা যদি ধনীদের দায়িত্বের দিকে তাকাই, তাহলে এটি তিনটি প্রধান স্তরে বিভক্ত করা যেতে পারে: ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজ।

 ব্যক্তি হিসেবে নিজের উন্নতি করা

আপনার জীবনে ধন আসার মানে হলো আপনি এক ধরনের সুযোগ পেয়েছেন। এই সম্পদ ব্যবহার করে আপনি নিজের জ্ঞান, দক্ষতা এবং আত্মশুদ্ধি ঘটাতে পারেন। মুন্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে:

“সত্যমেব জয়তে নানৃতং সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।”

অর্থাৎ সত্যের পথেই সাফল্য আসে। সুতরাং, ধন ব্যবহার করে সৎ পথে জীবনযাপন এবং আত্মার উন্নতি সাধন ধনীদের প্রধান কর্তব্য।

 পরিবারের কল্যাণে অবদান রাখা

ধনীদের দায়িত্ব হলো তাদের পরিবারকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। ধনের প্রাচুর্যে পরিবারে অহংকার বা অবজ্ঞা জন্মাতে পারে। এজন্য, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং তাদের মধ্যে সৎ চরিত্র গড়ে তোলা অপরিহার্য।

 সমাজের কল্যাণে অবদান রাখা

সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা একটি প্রধান দিক। সনাতন ধর্মে দান একটি পবিত্র কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে:

“দাতব্যং ভৈষযং দানং যোগ্যায় পাত্রায় চ দীয়তে।”

অর্থাৎ, যোগ্য পাত্রকে দান করুন। এটি আপনার ধনকে সত্যিকারের পুণ্যের পথে পরিচালিত করবে। ধনী ব্যক্তিরা যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং দরিদ্রদের সহায়তায় অবদান রাখেন, তাহলে সমাজের ভারসাম্য বজায় থাকে।

প্রাসঙ্গিক উদাহরণ

 রাজা হরিশচন্দ্রের দায়িত্ববোধ

রাজা হরিশচন্দ্র সত্য এবং দানের জন্য বিখ্যাত। তিনি নিজের সম্পদ ত্যাগ করে সমাজের কল্যাণে কাজ করেছিলেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে ধন কেবল ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য নয়, বৃহত্তর মানবতার সেবা করার জন্য।

 ধনীরাজ ধ্রুব

শ্রীমদ্ভাগবতে ধ্রুবের কাহিনী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে একজন সত্যিকার নেতা কেবল নিজের নয়, প্রজাদের মঙ্গলের কথা ভাবে। তিনি তাঁর ধন-সম্পদ ব্যবহার করেছিলেন তাঁর রাজ্যের উন্নতিতে।

 আজকের সমাজে বিল গেটস ফাউন্ডেশনের উদাহরণ

যদিও এটি সরাসরি সনাতন ধর্মের উদাহরণ নয়, বিল গেটস ফাউন্ডেশনের মতো উদ্যোগ আমাদের শেখায় যে ধনীদের উচিত তাঁদের সম্পদ ব্যবহার করে বিশ্বকে আরও ভালো জায়গা করে তোলা।

উদ্ধৃতি সনাতন ধর্ম থেকে

  •  বৃদ্ধারণ্যক উপনিষদ:

“ত্যেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা।”
অর্থাৎ, ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ কর।

  •  গীতা (১৭.২০):

“দাতব্যং ইতি যদ্ধানং দীয়তে’নুপকারিণে।”
অর্থাৎ, যারা কিছু ফেরত চায় না, তাদের কাছে দান করাই শ্রেষ্ঠ।

  •  রামায়ণ:

“পরহিত বাসিনঃ সন্তঃ।”
অর্থাৎ, যারা অন্যদের মঙ্গলের কথা ভাবে, তারাই প্রকৃত ধার্মিক।

  •  ঋগ্বেদ:

“আত্মানং বিদ্ধি।”
অর্থাৎ, নিজেকে জানুন এবং নিজের সম্পদের প্রকৃত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করুন।

ধনের অপব্যবহারের বিপদ

ধনের সঠিক ব্যবহার না হলে তা আপনার এবং সমাজের ক্ষতির কারণ হতে পারে। অহংকার, লোভ এবং দুর্নীতি ধন থেকে উদ্ভূত হতে পারে। তাই, আপনার সম্পদকে সৎভাবে ব্যবহার করা একান্ত প্রয়োজন।

উপসংহার

আপনার ধন শুধুমাত্র আপনার জন্য নয়। এটি সৃষ্টিকর্তার একটি উপহার, যা সঠিকভাবে ব্যবহার করার দায়িত্ব আপনার। আপনার সম্পদকে এমন কাজে ব্যবহার করুন যা আপনার জীবন এবং সমাজকে আরও সমৃদ্ধ করবে। আপনি যখন আপনার ধনের সঠিক ব্যবহার করবেন, তখন আপনার জীবনেই শান্তি এবং সমৃদ্ধি আসবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top