পরিবার আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সনাতন ধর্মে পরিবারকে শুধুমাত্র একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং এক ধরণের পবিত্র আশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আপনি এবং আমি, আমরা সবাই পরিবারের সঙ্গে এক অদৃশ্য বন্ধনে যুক্ত। এই বন্ধন ঠিকভাবে রক্ষা করতে গেলে সনাতন ধর্মের নির্দেশনাগুলো জানা এবং সেগুলোর চর্চা করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
সনাতন ধর্মে পরিবার ও দায়িত্ব
সনাতন ধর্মে পরিবারিক দায়িত্ব পালনের মূলমন্ত্র হলো ধর্ম (ধার্মিক দায়িত্ব), অর্থ (অর্থনৈতিক স্থিতি), কাম (ইচ্ছাপূরণ), এবং মোক্ষ (মুক্তি) – এই চারটি পুরুষার্থকে সুষমভাবে রক্ষা করা। পরিবারকে একটি আশ্রম হিসেবে ধরা হয়, যেখানে প্রত্যেকে একে অপরের কল্যাণের জন্য কাজ করে। গৃহস্থাশ্রম জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়, যেখানে একটি ব্যক্তি তার পরিবার, সমাজ এবং নিজের আত্মার মুক্তির জন্য দায়বদ্ধ।
মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য
“মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব” – উপনিষদে এই আদেশটি দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে শিখানো হয়, মাতা এবং পিতাকে দেবতার মতো সম্মান করতে হবে। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আপনার জীবনে মাতাপিতার অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ? তারা আমাদের শৈশব থেকে শুরু করে বড় হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরন্তর সমর্থন দিয়ে থাকেন। তাই তাদের যত্ন নেওয়া এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা আমাদের একটি প্রধান দায়িত্ব।
সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব
সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, সন্তানকে কেবল জন্মদান করাই যথেষ্ট নয়। তাদের সঠিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধ প্রদান করাও পিতামাতার কর্তব্য। “বিদ্যা বিতরণম্ সন্তানের শ্রেষ্ঠ দান।” আপনি কি আপনার সন্তানকে শুধু অর্থপূর্ণ শিক্ষা দিচ্ছেন, নাকি জীবনের নৈতিক দিকগুলো শেখানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন? সন্তানদের ভগবদ্ গীতা, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি পাঠ করার জন্য উৎসাহিত করুন। এগুলো তাদের জীবনের মূল্যবোধ এবং সঠিক পথে চলার অনুপ্রেরণা দেবে।
সঙ্গীর প্রতি দায়িত্ব
আপনার স্ত্রী বা স্বামীর প্রতি আপনার দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব কীভাবে দেখছেন? সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, “সহধর্মিণী” শব্দটি থেকে বোঝা যায় যে, জীবনসঙ্গী একে অপরের সঙ্গে জীবনের প্রতিটি দায়িত্ব ভাগ করে নেন। এই অংশীদারিত্বকে সম্মান করা এবং একে অপরের প্রতি ভালোবাসা এবং সহানুভূতি প্রদর্শন করা একান্ত প্রয়োজন। যেমন ভগবান শিব ও পার্বতীর সম্পর্ক আমাদের এই বিষয়ে শিক্ষা দেয় যে, একজন সঙ্গী কেবলমাত্র আনন্দের সময় নয়, দুঃখ এবং দায়িত্বের সময়ও পাশে থাকে।
ভাই-বোন এবং আত্মীয়দের প্রতি দায়িত্ব
“সঙ্ঘশক্তি কলৌ যুগে” – একত্রিত পরিবারকে শক্তিশালী এবং শান্তিপূর্ণ মনে করা হয়। আপনার ভাই-বোন এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করা আপনার পরিবারিক শৃঙ্খলা রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সমাজের প্রতি দায়িত্ব
পরিবারিক দায়িত্ব শুধুমাত্র বাড়ির ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়। সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, “সর্বজন হিতায়, সর্বজন সুখায়”। এর মানে, আপনি আপনার পরিবারকে ভালো রাখতে চাইলে সমাজের কল্যাণের কথাও ভাবতে হবে। পরিবারের সবাইকে একত্রিত করে দান-ধ্যান করা, প্রতিবেশীদের সাহায্য করা—এসব কাজ আপনার আত্মিক এবং পারিবারিক সুখের একটি পথ।
ধর্মীয় গ্রন্থের দৃষ্টিকোণ
সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রে পরিবারিক দায়িত্ব নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
- ভগবদ্ গীতা (৩.২১): “যেমন একজন মহান ব্যক্তি আচরণ করে, অন্যরা ঠিক তেমনটি অনুসরণ করে।” এটি থেকে বোঝা যায়, একজন ব্যক্তি তার পরিবারের জন্য কীভাবে রোল মডেল হতে পারেন।
- মনুস্মৃতি (৯.২৮২): “পিতা তার সন্তানকে শিক্ষা দিয়ে তাদের জীবনে শক্তিশালী করে তোলে।” এটি সন্তানের প্রতি পিতার দায়িত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
ব্যক্তিগত দায়িত্ব বনাম সমষ্টিগত সুখ
পরিবারিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আপনি একা সুখী হতে পারবেন না, তবে পুরো পরিবার এবং সমাজে একতা ও শান্তি আসবে। আপনি যদি আপনার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, তাহলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও সেটি অনুসরণ করবে।
চূড়ান্ত চিন্তা
পরিবারিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে, সনাতন ধর্ম আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে দিকনির্দেশনা দেয়। আপনি যদি এই শিক্ষাগুলো গ্রহণ করে চর্চা করেন, তাহলে শুধু আপনার পরিবার নয়, পুরো সমাজেরও উন্নতি হবে।