মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব – এটি এমন এক বিষয় যা সনাতন ধর্মে গভীর গুরুত্ব পায়। যখন আমি এই বিষয়ে ভাবি, আমার মনে আসে সনাতন ধর্মের মূলমন্ত্র “বসুধৈব কুটুম্বকম্” অর্থাৎ, এই সমগ্র পৃথিবীই একটি পরিবার। আপনি হয়তো জানেন বা হয়তো জানেন না, সনাতন ধর্ম আমাদের প্রতিটি কাজের পেছনে একটি গভীর নৈতিকতা এবং দায়িত্বের নির্দেশ দেয়। এই নৈতিকতা শুধু নিজের জন্য নয়, বরং সমাজ, প্রকৃতি এবং সমগ্র মানবজাতির প্রতি আমাদের আচরণে প্রতিফলিত হওয়া উচিত।
মানুষের প্রতি দায়িত্ব: সনাতন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি
সনাতন ধর্মের শাস্ত্র ও গ্রন্থগুলোতে আমরা অসংখ্যবার মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে পাঠ পাই। উদাহরণস্বরূপ, গীতা আমাদের শেখায় যে আমরা সবাই একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৩.২০) বলা হয়েছে:
“যৎ যৎ আচরতি শ্রেষ্ঠঃ তৎ তৎ এৱেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তৎ অনুবর্ততে।”
অর্থাৎ, একজন সৎ ব্যক্তি যেভাবে আচরণ করেন, অন্যরাও তাকে অনুসরণ করেন। এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে আপনার কাজের মাধ্যমে আপনি অন্যদের জন্য একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন।
আপনি হয়তো ভাবছেন, এই দায়িত্ব আসলে কীভাবে পালন করবেন? আসুন, কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ এবং নীতির মাধ্যমে তা বোঝার চেষ্টা করি।
অভুক্তকে অন্ন দান
একবার আমি একটি গ্রামে গিয়েছিলাম, যেখানে এক বৃদ্ধা তার প্রাপ্য অন্নের অর্ধেক একজন অভুক্ত শিশুকে দান করলেন। তখনই আমার মনে পড়ে গেল ঋগ্বেদের সেই মহান বাণী:
“আতিথ্যং ন ম পরিত্যজ্যাত।”
অর্থাৎ, অতিথি বা অভাবগ্রস্ত কাউকে কখনো উপেক্ষা করা উচিত নয়।
আপনার জীবনে হয়তো এমন অনেক মুহূর্ত আসে যখন আপনি কারো পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পান। এই দায়িত্ব পালন করা, একজন ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়া বা বিপদে পড়া ব্যক্তিকে সাহায্য করা, আমাদের মানবধর্মের অন্যতম দায়িত্ব।
প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ব
সনাতন ধর্মে প্রকৃতি এবং পরিবেশ রক্ষার গুরুত্বও অসীম। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে:
“মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিব্যাঃ।”
অর্থাৎ, পৃথিবী আমাদের মা এবং আমরা তার সন্তান।
আপনি কি ভাবতে পারেন, আপনার প্রতিটি কাজ প্রকৃতির উপর প্রভাব ফেলছে? প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো, বৃক্ষরোপণ, এবং প্রকৃতির প্রতি সদয় আচরণ করা মানেই আপনি সনাতন ধর্মের মূলনীতিগুলো মেনে চলছেন। আমি মনে করি, আপনি যদি এই পৃথিবীকে নিজের বাড়ি মনে করেন, তাহলে তার দেখাশোনাও আপনারই দায়িত্ব।
ক্ষুদ্র দায়িত্ব থেকে বৃহৎ লক্ষ্য
আপনার প্রতিদিনের জীবনে কিছু ছোট ছোট দায়িত্ব পালন করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, কারো মনে আঘাত না দেওয়া, নিজের কাজ সৎভাবে করা, এবং প্রতিটি সম্পর্ক সম্মানের সঙ্গে পরিচালনা করা। মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে:
“ধর্মস্য ত্বনুশাসনং।”
অর্থাৎ, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কর্ম করাই ধর্ম।
আপনি যদি আপনার ক্ষুদ্র দায়িত্বগুলো গুরুত্ব সহকারে পালন করেন, তাহলে তা সমাজে একটি বৃহৎ পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। যেমন, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করলে পরিবারটি সুসংহত হয় এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা পায়।
ক্ষমা এবং সহানুভূতির মহত্ব
আমরা প্রায়শই অন্যের ভুলে রাগ করি। কিন্তু সনাতন ধর্মে ক্ষমাকে এক বিশেষ মহৎ গুণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে:
“ক্ষমা ধর্মস্য লক্ষণম।”
অর্থাৎ, ক্ষমাই প্রকৃত ধর্ম।
আপনি যদি কাউকে ক্ষমা করতে পারেন, তাহলে আপনি নিজে মুক্তি পান এবং সেই ব্যক্তিও নতুন করে শুরু করার সুযোগ পান। এটি শুধু একটি দায়িত্ব নয়, বরং মানবতার প্রতি শ্রদ্ধার চর্চা।
শিক্ষার প্রসার
গুরুজন বা জ্ঞানীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অজ্ঞদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়ানোও সনাতন ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। উপনিষদে বলা হয়েছে:
“বিদ্যাদানং সর্বেশাং দানানাং প্রধানম।”
অর্থাৎ, জ্ঞানদান সব দানের মধ্যে সর্বোত্তম।
আপনার আশেপাশের যারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ান। এটি হতে পারে একটি শিশুকে পড়ানো, বা আপনার নিজের দক্ষতা কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া।
একটি সামগ্রিক দৃষ্টি
আপনি যদি সনাতন ধর্মের মূলনীতিগুলো গভীরভাবে অনুভব করেন, তাহলে দেখতে পাবেন এটি একেবারে জীবনের প্রতিটি দিক স্পর্শ করে। একজন ব্যক্তি হিসাবে আপনার দায়িত্ব শুধু নিজের সুখ অর্জন নয়, বরং অন্যদের জীবনকেও সুখী করা।
গীতা আমাদের একটি স্পষ্ট নির্দেশ দেয়:
“নিহত্য ধার্মিকং লোকং ন ধনং কিঞ্চন প্রাপ্যতে।”
অর্থাৎ, অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে কখনো প্রকৃত অর্জন সম্ভব নয়।
শেষ কথা
মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব পালন সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা। এটি কেবল একটি তত্ত্ব নয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগের বিষয়। আপনি কি ভেবেছেন, যদি প্রতিটি ব্যক্তি এই নীতিগুলো নিজের জীবনে প্রয়োগ করেন, তাহলে পৃথিবী কেমন হবে? এটি কি সত্যিই এক “রামরাজ্য”-এর সূচনা করবে না?
আমাদের সকলের উচিত নিজেদের জীবনকে এই শিক্ষা অনুযায়ী পরিচালিত করা। একবার ভাবুন, আপনার একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ কীভাবে আপনার চারপাশের পরিবেশ এবং মানুষকে উন্নত করতে পারে। তাহলে কি আপনি আজ থেকেই এই দায়িত্ব পালন শুরু করবেন? বসুধৈব কুটুম্বকম্ – এই দর্শন আপনার জীবনে কি ভূমিকা রাখতে পারে?