ভগবদ গীতায় নৈতিক শিক্ষা কী?

ভগবদ গীতা, একটি মহাকাব্যিক ধর্মগ্রন্থ, যা আমাদের জীবনের সংকটময় মুহূর্তে সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করে। এটি শুধু একটি গ্রন্থ নয়, বরং আমাদের জীবনের প্রতিটি দিককে উন্নত করার একটি নির্দেশিকা। গীতার শিক্ষা জীবনকে কীভাবে ভারসাম্যপূর্ণ, নৈতিক ও অর্থবহ করা যায়, তা তুলে ধরে। আজ আমি তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই কীভাবে গীতা আমাদের জীবনে নৈতিক শিক্ষা দেয় এবং কীভাবে আমরা সেই শিক্ষাকে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে পারি।

জীবনের সংকটের মুহূর্তে গীতা

তোমরা সবাই জানো, ভগবদ গীতার সূচনা ঘটে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে অর্জুন দ্বিধাগ্রস্ত ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। তিনি যুদ্ধ করতে চাননি, কারণ তাঁর সামনে ছিলেন তাঁর আত্মীয়-স্বজন, গুরুজন ও বন্ধু। এই সময় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নৈতিকতার পাঠ দেন এবং জানান কীভাবে ধর্ম ও কর্তব্যের পথে অটল থাকা যায়। শ্রীকৃষ্ণ বলেন:

“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোস্ত্বকর্মণি।”
(ভগবদ গীতা ২.৪৭)

অর্থাৎ, তোমার কাজ করার অধিকার আছে, কিন্তু ফলের আশা করা তোমার কর্তব্য নয়। এই কথাটি আমাদের জীবনে অনেক বড় শিক্ষা দেয়। আমাদের জীবনেও অনেক সময় আমরা কাজের ফলাফল নিয়ে এতটাই চিন্তিত হয়ে পড়ি যে আমাদের কর্তব্য ভুলে যাই।

নৈতিকতার মূল ভিত্তি: কর্তব্যপরায়ণতা

গীতার অন্যতম শিক্ষা হল ‘স্বধর্ম পালন’, অর্থাৎ নিজের কর্তব্যে অবিচল থাকা। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝান যে যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর কর্তব্য হল একজন ক্ষত্রিয়ের মতো যুদ্ধ করা। তিনি বলেন:

“শ্রেয়ান্‌ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।”
(ভগবদ গীতা ৩.৩৫)

অর্থাৎ, নিজের ধর্মে (কর্তব্যে) মৃত্যু হওয়াও শ্রেয়, অন্যের কর্তব্য পালন সর্বদা বিপজ্জনক। এই নৈতিক শিক্ষাটি আমাদের শেখায়, নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি কখনও পিছপা না হতে। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষক যদি তার শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে না পারেন, তাহলে সে তার নৈতিক দায়িত্ব পালন করছে না। একইভাবে, একজন চিকিৎসক তার রোগীদের সেবায় অবহেলা করলে তিনি তার নৈতিকতা বিসর্জন দিচ্ছেন।

সংযম ও ইন্দ্রিয়নিয়ন্ত্রণ: জীবনের ভারসাম্য

গীতা আমাদের ইন্দ্রিয়নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। আমাদের জীবনে প্রলোভন, লোভ, রাগ ইত্যাদি নানান অপ্রয়োজনীয় অনুভূতি আমাদের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন:

“যদা সংহরতে চায়ং কূর্মোংগানীব সর্বশঃ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।”
(ভগবদ গীতা ২.৫৮)

অর্থাৎ, কচ্ছপ যেমন নিজের অঙ্গ প্রত্যাহার করে নেয়, তেমনই যে ব্যক্তি ইন্দ্রিয়ের সংযম করতে পারে, সে স্থিতধী বা স্থিরচেতা ব্যক্তি হয়।

উদাহরণস্বরূপ, ধরো তুমি পড়াশোনার সময় মোবাইল ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছো। যদি তুমি ইন্দ্রিয়সংযম করতে না পারো, তাহলে তোমার মনোযোগ নষ্ট হবে এবং জীবনের লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব হয়ে উঠবে। গীতার এই শিক্ষা আমাদের শেখায় কীভাবে নিজের প্রলোভনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারি।

আত্ম-অভ্যন্তরীণ শক্তির সন্ধান

গীতার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল নিজের আত্মার শক্তি উপলব্ধি করা। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝান যে মানুষ আসলে অমর আত্মা। তিনি বলেন:

“ন জায়তে ম্রিয়তে वा কদাচিন্।
নায়ং ভূত্বা ভবিতা वा ন ভূয়ঃ।”
(ভগবদ গীতা ২.২০)

অর্থাৎ, আত্মা কখনও জন্ম নেয় না এবং কখনও মৃত্যুবরণ করে না। এটি চিরন্তন, অমর ও অবিনশ্বর। এই শিক্ষাটি আমাদের জীবনে প্রয়োজনীয়। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী সমস্যাগুলিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের উচিত নিজের আত্মার শক্তি এবং সত্যিকারের স্বরূপকে বুঝতে চেষ্টা করা।

আমাদের জীবনে অনেক সময় আমরা ব্যর্থতা ও হতাশার মুখোমুখি হই। সেই সময় এই গীতার শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা অমর আত্মা এবং এই পার্থিব ব্যর্থতা শুধুমাত্র সাময়িক।

অহিংসা ও সমতা: জীবনের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি

গীতায় অহিংসা ও সকলের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ বলেন:

“বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ।”
(ভগবদ গীতা ৫.১৮)

অর্থাৎ, প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি সব কিছুতেই সমত্বের দৃষ্টিতে দেখে, তা ব্রাহ্মণ হোক বা গরু, হাতি কিংবা কুকুর। এই শিক্ষা আমাদের মানবিক হতে শেখায়। সমাজে আমরা প্রায়ই মানুষকে তাদের অবস্থান, জাতি বা অর্থের ভিত্তিতে বিচার করি। কিন্তু গীতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সবাই সমান এবং আমাদের উচিত সকলের প্রতি সম্মান দেখানো।

জীবনে গীতার শিক্ষার প্রয়োগ

এখন প্রশ্ন আসে, কীভাবে আমরা গীতার এই শিক্ষাগুলোকে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করব?

  1. কর্তব্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দাও: তোমার কাজ করো মন দিয়ে, ফল নিয়ে চিন্তা কোরো না।
  2. সংযম অনুশীলন করো: মন ও ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে রেখে জীবনের লক্ষ্য পূরণের পথে এগিয়ে যাও।
  3. মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখো: সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতায় সমানভাবে স্থির থাকো।
  4. অহংকার ত্যাগ করো: মনে রেখো, তুমি আত্মা—এই দেহ ও মন নয়।
  5. সমত্বের দৃষ্টিভঙ্গি রাখো: সকলের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার মনোভাব রাখো।

শেষ কথা

ভগবদ গীতা শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি জীবনের একটি দর্শন, যা আমাদের প্রতিটি মুহূর্তে পথ দেখায়। নৈতিকতার প্রশ্নে গীতা আমাদের শেখায়, কিভাবে সৎ পথে থেকে নিজের কর্তব্য পালন করতে হবে এবং জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেতে হবে।

তাহলে বলো, জীবনকে আরও উন্নত করতে গীতার এই অমূল্য শিক্ষাগুলো তুমি আজ থেকেই গ্রহণ করবে তো? মনে রেখো, গীতার প্রতিটি শ্লোক আমাদের জীবনের অন্ধকার দূর করে আলোর পথ দেখায়।

“তোমার জীবনটাই একটি যুদ্ধক্ষেত্র, তুমি কি অর্জুনের মতো নিজের সত্য পথ খুঁজে নিতে প্রস্তুত?”


জয় শ্রীকৃষ্ণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top