আমরা জীবনের যে পর্যায়েই থাকি না কেন, দাম্পত্য জীবন আমাদের জীবনে এক বিশেষ অধ্যায়। বিয়ে শুধু দুটি মানুষের মনের মিল নয়, এটি দুটি আত্মার সংযোগ। সনাতন ধর্মে বিয়েকে একটি পবিত্র বন্ধন হিসেবে দেখা হয়, যা মানব জীবনের চারটি পুরুষার্থের (ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ) মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে বিয়ের আগে ও পরে দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে সনাতন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হলো।
বিয়ের আগে: আত্মবিশ্লেষণ ও প্রস্তুতি
বিয়ের আগে আমরা নিজেদের প্রস্তুত করতে পারি একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ দাম্পত্য জীবনের জন্য। সনাতন ধর্মে বিয়েকে শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং এক ধরনের আধ্যাত্মিক সাধনা হিসেবে গণ্য করা হয়।
নিজের আত্মপরিচয় জানা
“আত্মানং বিদ্ধি” (আপনার আত্মাকে জানুন) – উপনিষদ।
বিয়ের আগে আমাদের উচিত নিজের চরিত্র, মূল্যবোধ এবং জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা। যদি আপনি জানেন আপনার জীবনের উদ্দেশ্য কী, তাহলে আপনার সঙ্গীকে বেছে নেওয়াও সহজ হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার লক্ষ্য মোক্ষ প্রাপ্তি হয়, তাহলে এমন একজন সঙ্গী নির্বাচন করুন যিনি আপনার সেই লক্ষ্যকে সমর্থন করবেন।
শাস্ত্র অধ্যয়ন
“ধর্মে চরতি ইতি ধর্ম:” (যা ধর্মের পথে চালিত হয়, সেটাই ধর্ম) – মনুস্মৃতি।
বিয়ের আগে শাস্ত্র অধ্যয়ন করা এবং বিবাহের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সনাতন ধর্মে বিয়ে হলো একে অপরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার একটি প্রতিশ্রুতি। তাই এটি একটি গভীর বোঝাপড়ার মাধ্যমে শুরু হওয়া উচিত।
সঠিক মানসিক প্রস্তুতি
বিয়ের আগে আমাদের নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক: রামায়ণে দেখা যায়, শ্রী রাম এবং সীতা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগে নিজেদের কর্তব্য এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাঁরা জানতেন যে দাম্পত্য জীবন শুধু সুখভোগ নয়, বরং দায়িত্ব এবং আত্মত্যাগের মিশ্রণ।
বিয়ের পরে: দায়িত্ব এবং ধর্ম
বিয়ের পরে দাম্পত্য জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দায়িত্ব পালন। সনাতন ধর্মে দাম্পত্য জীবনের মূল ভিত্তি হলো পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং দায়িত্ববোধ।
ধর্মের প্রতি দায়িত্ব
“পতি ধর্মে স্থিতঃ পত্নীং ধর্মে স্থাপয়তি” (স্বামী ধর্মে অবিচল থাকলে স্ত্রীও ধর্মে অবিচল থাকে) – মহাভারত।
বিয়ের পরে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের দায়িত্ব হলো ধর্মাচরণে একে অপরকে সমর্থন করা। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন স্বামী প্রতিদিন পূজা করেন, তাহলে স্ত্রীর উচিত তাঁকে সেই সময় শান্ত পরিবেশ প্রদান করা। একইভাবে, স্ত্রীর ধর্মীয় কার্যকলাপেও স্বামীর সমর্থন প্রয়োজন।
একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা
“সহধর্মিণী” (ধর্মপথে সঙ্গী)
স্বামী এবং স্ত্রী একে অপরের সহধর্মিণী। সনাতন ধর্মে স্ত্রীকে শুধু একজন সঙ্গিনী নয়, বরং একজন সমান অংশীদার হিসেবে গণ্য করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মহাভারতে দ্রৌপদী ছিলেন তাঁর স্বামীদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক।
পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব
“কুলধর্মে স্থিতো ভবতি সনাতনধর্মে” (পরিবারের ধর্ম মানাই সনাতন ধর্ম) – শ্রীমদ্ভাগবত।
পরিবার এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করা দাম্পত্য জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উদাহরণস্বরূপ, রাম এবং সীতা তাঁদের সন্তান লব-কুশকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে একজন আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
আত্মত্যাগ ও পরোপকার
দাম্পত্য জীবনে কখনো কখনো আত্মত্যাগ করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, মহাভারতের গল্পে দেখা যায়, রাজা হরিশচন্দ্র তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানের জন্য নিজের সমস্ত কিছু ত্যাগ করেছিলেন। এই আত্মত্যাগই দাম্পত্য জীবনকে আরও মজবুত করে।
দৈনন্দিন জীবনে সনাতন ধর্মের অনুশীলন
দাম্পত্য জীবনে সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা হলো পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহযোগিতা। এর জন্য কিছু সহজ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়:
- প্রতিদিন একসঙ্গে প্রার্থনা করা।
- একে অপরের মতামত এবং আবেগকে সম্মান করা।
- ধর্মীয় আচার এবং উৎসবে একসঙ্গে অংশ নেওয়া।
- সন্তানদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করা।
উপসংহার
সনাতন ধর্ম আমাদের শিক্ষা দেয় যে দাম্পত্য জীবন একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা। এটি শুধুমাত্র একটি সামাজিক বন্ধন নয়, বরং দুটি আত্মার মেলবন্ধন। বিয়ের আগে আত্মবিশ্লেষণ এবং প্রস্তুতি এবং বিয়ের পরে দায়িত্ব এবং ধর্মাচরণ – এই দুটি দিকেই আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।