আমরা যারা সনাতন ধর্ম অনুসরণ করি, তাদের কাছে ধর্ম মানেই জীবনযাপনের সঠিক পথ। আপনি যদি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ধর্মের আদর্শ মেনে চলেন, তাহলে জীবনের সব বাধা অতিক্রম করা সহজ হয়। আজ আমি আপনাকে বলব, বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্য সম্পর্কে সনাতন ধর্ম কী শিক্ষা দেয়।
সনাতন ধর্মে বাবা-মায়ের স্থান
সনাতন ধর্মে বাবা-মায়ের স্থান অত্যন্ত উচ্চ। উপনিষদে বলা হয়েছে:
“মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব।”
অর্থাৎ, মাকে দেবীর মতো আর বাবাকে দেবতার মতো পূজা করতে হবে। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, কেন এই কথাটি এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে? কারণ আমাদের জন্ম এবং জীবন, উভয়ই তাঁদের অবদান।
সন্তানের কর্তব্য: সনাতন ধর্মের নির্দেশিকা
আপনি যদি সনাতন ধর্মের শাস্ত্রগুলোর দিকে তাকান, তবে দেখবেন সেখানে সন্তানের কর্তব্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এখানে কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করছি, যা আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক হতে পারে।
সেবা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন
আপনার বাবা-মা যখন বৃদ্ধ হন, তখন তাদের যত্ন নেওয়া আপনার প্রধান কর্তব্য। মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে:
“যঃ পিতা স্বং পুত্রং রক্ষতি, সঃ পুত্রো ন রক্ষিতব্যঃ।”
অর্থাৎ, যে সন্তান তার পিতামাতাকে রক্ষা করে না, সে নিজেও সুরক্ষিত হওয়ার যোগ্য নয়।
এটি শুধু শাস্ত্রের কথা নয়, জীবনের এক চিরন্তন সত্য। আপনি যখন বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখান, তখন তার প্রতিদান স্বরূপ আপনি সন্তানের কাছ থেকে একই ব্যবহার পাবেন।
ভালো মানুষ হওয়া
সনাতন ধর্মে ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের বড় কর্তব্য বলে বিবেচিত। ভগবদ্গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“যথা মা গুরুহিৎ কার্যম।”
অর্থাৎ, গুরু ও পিতামাতার মতের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। আপনি যখন আপনার জীবনে সৎ থাকেন, আপনার কাজের মাধ্যমে বাবা-মায়ের নাম উজ্জ্বল করেন, তখন সেটাই তাদের প্রতি আপনার সেরা উপহার।
উদাহরণ হিসেবে ধরুন, আপনি যদি নিজের কাজের ক্ষেত্রে সৎ ও নিষ্ঠাবান থাকেন, তবে আপনার বাবা-মা গর্বিত হন। তাদের এই গর্ব আপনার জীবনের সার্থকতা।
তাদের পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া
বাবা-মায়ের অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনের সবথেকে মূল্যবান সম্পদ। মহাভারতে একটি ঘটনা আছে, যেখানে কুণ্ডলধারী কর্ণ তার মায়ের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে নিজের জীবনকে বিপদে ফেলে। এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে, বাবা-মায়ের পরামর্শ অমূল্য এবং তাদের কথাকে সম্মান করা আমাদের কর্তব্য।
আপনি কি কখনো ভেবেছেন, কেন বাবা-মা আপনার ভালো চান? কারণ তারা আপনাকে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি উপহার দিতে চান। সনাতন ধর্ম শেখায়, তাদের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেওয়া জীবনের পথে আমাদের সাফল্যের চাবিকাঠি।
অর্থনৈতিক ও মানসিক সহায়তা দেওয়া
আপনার বাবা-মা যদি আর্থিক বা মানসিক সহায়তার প্রয়োজন অনুভব করেন, তবে সেটি দেওয়া আপনার দায়িত্ব। শ্রীমদ্ভাগবতে উল্লেখ রয়েছে:
“যে সন্তান বাবা-মায়ের আর্থিক ও মানসিক চাহিদা পূরণ করে, সে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়।”
আমাদের চারপাশে অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে সন্তানরা বাবা-মায়ের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়ে জীবনে ব্যর্থ হয়েছে। আপনি যদি তাদের ভালোবাসা আর সম্মান দেখান, তবে সেটাই আপনার আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে সহায়ক হবে।
তাদের ভালো-মন্দের খবর রাখা
আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ততায় আমরা অনেক সময় ভুলে যাই, যে বাবা-মায়ের কাছে আমাদের ছোট্ট একটা ফোন কলও কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শাস্ত্রে বলা হয়েছে:
“যে ব্যক্তি নিজের মায়ের কষ্টের প্রতি উদাসীন, সে পরকালে শাস্তি পায়।”
আপনার বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং তাদের অনুভূতিগুলোর কদর করা সনাতন ধর্মের অন্যতম শিক্ষা।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শিক্ষা
আমি নিজেও জীবনের অনেক ক্ষেত্রে এই শিক্ষাগুলো প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি। আমার বাবা-মায়ের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, কারণ তাদের দেওয়া শিক্ষা ও আশীর্বাদই আমার জীবনের চলার পথকে সুগম করেছে। আমি বুঝেছি, যতই আমরা তাদের পাশে থাকি, ততই আমাদের জীবন শান্তিময় হয়ে ওঠে।
আপনিও কি বাবা-মায়ের প্রতি আপনার কর্তব্য পালন করছেন? নাকি আপনি এই প্রশ্নে নিজেকে অস্বস্তিতে পাচ্ছেন? যদি উত্তরটা “না” হয়, তাহলে আজই তাদের প্রতি আপনার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করুন।
সমাপ্তি
বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন শুধু আপনার দায়িত্ব নয়, এটি আপনার আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ। আপনি যখন এই কর্তব্য পালন করেন, তখন আপনি সনাতন ধর্মের মূল আদর্শ মেনে চলেন। আপনার বাবা-মা কি আপনার কাছ থেকে এই ভালোবাসা ও যত্ন আশা করেন না?
তাহলে কেন দেরি করবেন? তাদের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিন, কারণ সেটাই আপনাকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। “আপনার কর্মই আপনার ধর্ম।”