প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সনাতন ধর্মের ভূমিকা কী ছিল?

তোমরা কি জানো, সনাতন ধর্ম শুধু একটি ধর্ম নয়, এটি আদর্শ, নৈতিকতা এবং শাসনব্যবস্থার ভিত্তি? প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সনাতন ধর্মের ভূমিকা অপরিসীম ছিল। রাজনীতি তখন কেবল ক্ষমতা দখলের খেলা ছিল না, বরং মানুষের কল্যাণ, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার একটি উপায় ছিল। সনাতন ধর্মের মূলনীতি যেমন সত্য, ধর্ম, শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার সেই সময়ের শাসকদের জন্যও পথপ্রদর্শক ছিল।

রাজধর্ম: শাসকদের কর্তব্য

সনাতন ধর্মে রাজাদের জন্য একটি স্পষ্ট দায়িত্ব নির্ধারণ করা ছিল, যাকে বলা হয় “রাজধর্ম”। রাজা শুধু শাসক নন, তিনি ছিলেন প্রজার সেবক ও অভিভাবক। “প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং চ হিতে রতঃ।” অর্থাৎ, রাজা তার প্রজাদের সুখে নিজের সুখ খুঁজে নেন এবং তাদের কল্যাণেই তিনি রত থাকেন। (মহাভারত)

যেমন উদাহরণ হিসেবে আমরা মহাভারতের রাজা যুধিষ্ঠিরের কথা বলতে পারি। যুধিষ্ঠির কখনোই নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হননি। তার শাসনকালে প্রজা ছিল সুখী ও শান্তিপূর্ণ। তিনি সবসময় ধর্ম অনুযায়ী শাসন করতেন এবং ন্যায়বিচারের উপর জোর দিতেন।

রামরাজ্য: আদর্শ শাসনব্যবস্থা

প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক আদর্শের সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ হলো রামরাজ্য। রামরাজ্য শুধুই একটি কল্পনা নয়, এটি ছিল সুশাসন, ন্যায়বিচার এবং মানুষের কল্যাণের প্রতীক। রামচন্দ্র ছিলেন একজন আদর্শ রাজা যিনি সবসময় ধর্ম ও ন্যায়কে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। “অহিংসা পরমো ধর্মঃ” – এই নীতির অনুসরণে তিনি কোনো অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ করেননি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন।

রামায়ণে আমরা দেখতে পাই, রামচন্দ্রের শাসনে কেউ অভুক্ত ছিল না, কেউ অবিচারের শিকার হতো না। এই শাসনব্যবস্থায় প্রতিটি মানুষের জীবন ছিল সুরক্ষিত। এই আদর্শ সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষার প্রতিফলন।

ধন ও রাজনীতির ভারসাম্য

সনাতন ধর্মে আর্থিক শৃঙ্খলা এবং রাজনীতির মধ্যে একটি সুন্দর ভারসাম্য বজায় রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শাস্ত্র অনুযায়ী রাজা কখনোই নিজস্ব স্বার্থে রাজ্যের সম্পদ ব্যবহার করতে পারতেন না। সম্পদ ছিল প্রজাদের কল্যাণের জন্য। চাণক্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেছেন, “রাজ্যের ধন প্রজারই ধন।” এই নীতির উপর ভিত্তি করেই প্রাচীন ভারতের রাজনীতিতে দুর্নীতির স্থান ছিল না।

উদাহরণ হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনের কথা বলা যায়। চাণক্যের পরামর্শে তিনি একটি শক্তিশালী কিন্তু ন্যায়নিষ্ঠ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে কর ব্যবস্থা ছিল ন্যায্য এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ছিল সুশৃঙ্খল।

ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের ভূমিকা

সনাতন ধর্মে সমাজকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছিল – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। ব্রাহ্মণরা ছিলেন রাজাদের পরামর্শদাতা, তারা রাজাকে ধর্ম ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতেন। ক্ষত্রিয়রা ছিলেন শাসক ও রক্ষক, যারা রাজ্যের নিরাপত্তা ও শান্তি বজায় রাখার জন্য দায়ী ছিলেন। এই দুই শ্রেণির সমন্বয়ে একটি সুসংহত রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।

বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, “যথা ধর্ম তথা জয়।” অর্থাৎ যেখানে ধর্মের চর্চা হয়, সেখানেই বিজয় আসে। রাজারা যদি ধর্ম অনুযায়ী শাসন চালাতেন, তবে তাদের রাজ্যে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত ছিল।

যুদ্ধের নীতি: ধর্মযুদ্ধ

সনাতন ধর্মে যুদ্ধের নীতিও নির্ধারিত ছিল। কোনো যুদ্ধ যদি ধর্ম ও ন্যায় রক্ষার জন্য হয়, তবে সেটিকে ধর্মযুদ্ধ বলা হতো। মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের উদাহরণ আমাদের সবার জানা। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, “ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়ো ন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে।” (ভগবদ গীতা ২.৩১)

অর্থাৎ, একজন ক্ষত্রিয়ের জন্য ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধের চেয়ে বড় কোনো কর্ম নেই। এই নীতি অনুযায়ী, শাসকরা কখনোই অন্যায় যুদ্ধ করতেন না এবং প্রজাদের অযথা কষ্ট দিতেন না।

আধুনিক জীবনে সনাতন ধর্মের শিক্ষা

আজকের যুগে আমরা যদি প্রাচীন ভারতের সনাতন ধর্মের রাজনৈতিক আদর্শ থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তাহলে সমাজে ন্যায়বিচার, সুশাসন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। রাজনীতি যদি সত্য ও ধর্মের পথে চলে, তবে সমাজের কল্যাণ অবধারিত। আমাদের উচিত শ্রীকৃষ্ণের গীতার শিক্ষা অনুসরণ করা, যেখানে তিনি বলেছেন, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।” অর্থাৎ নিজের ধর্ম ও কর্তব্য পালন করাই শ্রেষ্ঠ, অন্যের কর্তব্যে বিচলিত হওয়া বিপজ্জনক।

শেষকথা

সনাতন ধর্ম কেবল একটি ধর্ম নয়, এটি একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা প্রাচীন ভারতের রাজনীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। সত্য, ন্যায়, শৃঙ্খলা ও কল্যাণ এই চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে ছিল প্রাচীন শাসনব্যবস্থা। আজকের যুগেও এই শিক্ষাগুলো যদি আমরা রাজনীতি ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগ করি, তাহলে একটি উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top