পরিবেশ রক্ষায় নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে সনাতন ধর্ম কী বলে?

আমরা সবাই জানি, পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শুধুমাত্র ভোগের নয়; এটি আমাদের অস্তিত্বের মূলভিত্তি। তবে, কীভাবে আমরা এই সম্পর্ককে সঠিকভাবে পালন করতে পারি? সনাতন ধর্ম আমাদের পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার কথা বলে, যা আজকের দিনে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই লেখায় আমি এবং তুমি একসাথে সনাতন ধর্মের আলোকে পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব।

প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব

সনাতন ধর্মে প্রকৃতিকে মা রূপে বিবেচনা করা হয়েছে। ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে:

“মাতা ভূমি: পুত্রো অহং পৃথিব্যাঃ।”

অর্থাৎ, পৃথিবী আমাদের মাতা এবং আমরা তার সন্তান। এই সম্পর্কই আমাদের পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলে। যেমন তুমি মায়ের যত্ন নাও, তেমনই পৃথিবীর প্রতিও আমাদের যত্নবান হতে হবে। মাটি, জল, বাতাস – সবকিছুকেই পবিত্র বলে মনে করা হয়েছে।

পরিবেশ রক্ষায় ব্যক্তিগত ভূমিকা

তুমি হয়তো ভাবছো, “আমার একার ভূমিকা কি পার্থক্য আনবে?” সনাতন ধর্ম বলে, প্রতিটি ছোট কাজই বৃহৎ পরিবর্তনের সূচনা করে। ভাবো, একটি গাছ লাগানোর মাধ্যমে তুমি কত প্রাণীর আশ্রয় তৈরি করছো। মহাভারতে বলা হয়েছে:

“যে ব্যক্তি একটি বৃক্ষ রোপণ করেন, তিনি তার দশ প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদ সৃষ্টি করেন।”

আমি নিজেও চেষ্টা করি গাছ লাগানোর এবং তোমাকেও উৎসাহিত করি। প্লাস্টিক ব্যবহারে সংযম আনো, জলের অপচয় বন্ধ করো – এই ছোট ছোট পদক্ষেপই প্রকৃতির প্রতি আমাদের ভালবাসার প্রকাশ।

প্রকৃতিকে দেবতা হিসেবে পূজা

সনাতন ধর্মে আমরা গঙ্গা, যমুনা, তপন দেবতা (সূর্য), এবং অগ্নিদেবতাকে পূজা করি। এই পূজার উদ্দেশ্য শুধু আধ্যাত্মিক নয়, পরিবেশের প্রতি কৃতজ্ঞতাও। গঙ্গাকে যদি আমরা দেবী মনে করি, তবে তার দূষণ কেন করব? তুমি কি কখনো ভেবে দেখেছো, আমরা গঙ্গার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি, কিন্তু তার সঙ্গে ব্যবহার করি বিপরীতভাবে। ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে:

“আপঃ স্বস্তয়ঃ।”

অর্থাৎ, জলের মধ্যে শান্তি বিদ্যমান। জলের সঠিক ব্যবহার এবং সংরক্ষণ আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

প্রাচীন ভারতের পরিবেশ রক্ষার শিক্ষা

প্রাচীন ভারতে পরিবেশ রক্ষার প্রচেষ্টা ছিল আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। উদাহরণস্বরূপ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে বন সংরক্ষণের জন্য রাজ্যস্তরে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। রাজা অশোকের শাসনকালে গাছ লাগানোর জন্য এবং পশুপাখি রক্ষার জন্য আলাদা আইন তৈরি করা হয়েছিল।

তুমি কি জানো, এমনকি গ্রামে গ্রামে “ব্রহ্মচার্য বন” নামে পবিত্র বন ছিল যেখানে বৃক্ষছেদন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল? এইসব উদাহরণ থেকে আমরা শিখতে পারি যে, পরিবেশ রক্ষা একটি নৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্ব।

গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক ও বার্তা

  •  “প্রকৃতির প্রতি যে ব্যক্তি সদয়, সে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের প্রতি সদয়।” — ভবদ্গীতা।
  •  “যে ব্যক্তি পৃথিবীকে রক্ষা করে, সে নিজেকেও রক্ষা করে।” — ঋগ্বেদ।
  •  “ধর্মের মূল ভিত্তি হলো অহিংসা, যা শুধু জীবদের প্রতি নয়, প্রকৃতির প্রতিও প্রযোজ্য।”— মনুস্মৃতি।

তুমি কী করতে পারো?

পরিবেশ রক্ষার জন্য তোমার কিছু সহজ উদ্যোগ হতে পারে:

  • গাছ লাগানো: প্রতিবছর অন্তত একটি গাছ লাগাও।
  • জল সংরক্ষণ: অপ্রয়োজনীয়ভাবে জলের অপচয় বন্ধ করো।
  • প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো: পরিবেশ বান্ধব জিনিসপত্র ব্যবহার করো।
  • পরিবেশ শিক্ষা: তোমার চারপাশের মানুষকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সচেতন করো।

আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের দায়িত্ব

তুমি এবং আমি যদি আজকের দিন থেকে পরিবেশ রক্ষায় নিজেদের উৎসর্গ করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে পারব। সনাতন ধর্মে পরিবেশকে কেবল একটি সম্পদ হিসেবে নয়, বরং ঈশ্বরের প্রকাশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাই, পরিবেশ রক্ষায় দায়িত্ব নেওয়া ঈশ্বরের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একটি পথ।

শেষ করার আগে তোমার কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই: তুমি কি তোমার দৈনন্দিন জীবনে এমন কিছু করার চেষ্টা করবে, যা পরিবেশকে সুস্থ রাখবে এবং সনাতন ধর্মের শিক্ষাকে সম্মান জানাবে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top