সনাতন ধর্ম আমাদের এমন এক জীবনধারা শিখিয়েছে যা প্রকৃতি, সমাজ ও জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নারী ও পুরুষের প্রতি সমান আচরণ নিয়ে সনাতন ধর্মের দর্শন গভীর, হৃদয়স্পর্শী এবং সময়োপযোগী। আমি যখন সনাতন ধর্মের শাস্ত্রগুলির দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই যে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমান অধিকার ও সম্মানের বীজ সেই আদিকাল থেকেই রোপিত হয়েছে। আসুন, আজ আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।
নারী ও পুরুষের সমানতা: শাস্ত্রের আলোয় দৃষ্টিভঙ্গি
সনাতন ধর্মের মূলমন্ত্র হল “সর্ব ভুতেষু সমত্ত্বম্”—অর্থাৎ সমস্ত জীবের প্রতি সমান দৃষ্টি। আমাদের উপনিষদ, বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্র বারবার বলেছেন যে আত্মা লিঙ্গভেদ করে না। কাঠোপনিষদে বলা হয়েছে:
“ন যোজ্যাং কিঞ্চন বিদ্যতে”
(আত্মার কোনো ভেদাভেদ নেই। এটি সবার মধ্যে একই।)
এটি স্পষ্টভাবে বোঝায় যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো প্রকার বৈষম্যের স্থান নেই। আত্মার দৃষ্টিতে আমরা সবাই সমান।
নারীর মহিমা: সনাতন ধর্মে উদাহরণ
নারীদের সম্মানের জন্য সনাতন ধর্মে অনেক উদাহরণ রয়েছে। এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত শেয়ার করছি:
- মাতা, শাক্তি ও দেবীর প্রতিমা
সনাতন ধর্মে নারীকে “মাতৃরূপেণ” দেখা হয়েছে। মা দুর্গা, মা লক্ষ্মী, এবং মা সরস্বতী হলেন সেই শক্তির প্রতীক, যা সমগ্র বিশ্বকে পরিচালনা করেন। আমরা নারীদের দেবীরূপে পূজা করি।
মনে পড়ে কি, মহিষাসুর বধের গল্প? মা দুর্গা সেখানে কেবল শক্তির প্রতীক নন, নারীর অপরাজেয় সাহস ও প্রজ্ঞারও উদাহরণ। - গার্গী ও মৈত্রেয়ী: জ্ঞানের আলোকবর্তিকা
ঋগ্বেদের সময়ে গার্গী ও মৈত্রেয়ী ছিলেন সেই নারীরা, যাঁরা জ্ঞানচর্চা ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। গার্গীর ব্রহ্মজিজ্ঞাসা আজও প্রাসঙ্গিক।
“ব্রহ্ম সত্যং জ্ঞানং অনন্তম্”—এই সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য নারীদের অধিকার ছিল সমান। - সীতা ও দ্রৌপদীর শিক্ষা
মহাভারত ও রামায়ণে আমরা সীতার ধৈর্য এবং দ্রৌপদীর সাহসের উদাহরণ পাই। সীতা কেবল একজন স্ত্রী নন, তিনি প্রকৃতির প্রতীক। আবার দ্রৌপদী, একজন নারী হয়েও, দুর্যোধনের অপমানের প্রতিবাদ করে নারীর সম্মানের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
নারী ও পুরুষের মধ্যে সমান আচরণ: বাস্তব জীবনের প্রয়োগ
আপনি হয়তো ভাবছেন, “শাস্ত্রের কথাগুলো সুন্দর, কিন্তু তা কি আজকের সমাজে বাস্তবায়িত হয়?” সত্যি বলতে, সনাতন ধর্ম আমাদের যা শিখিয়েছে, তা আধুনিক সমাজে খুবই প্রাসঙ্গিক। উদাহরণস্বরূপ:
- শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ
গার্গী ও মৈত্রেয়ীর গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। - পরিবারে সমান দায়িত্ব
পরিবারে নারী শুধু ঘর সামলাবেন আর পুরুষ বাইরে কাজ করবেন—এমন ধারণা সনাতন ধর্ম সমর্থন করে না। বরং উভয়ের মধ্যে সমান সহযোগিতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। - নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা
মহাভারতের দ্রৌপদী আমাদের শেখায় যে নারীর মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব পুরো সমাজের। “যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে, রমন্তে তত্র দেবতাঃ”—যেখানে নারীদের সম্মান করা হয়, সেখানে দেবতারা বাস করেন।
বৈষম্যের মূলে আঘাত: কীভাবে আমরা পরিবর্তন আনতে পারি?
সনাতন ধর্মের শিক্ষা আমাদের বলে যে, বৈষম্য কেবল অজ্ঞতার ফল। ভগবদ্গীতার একটি প্রসিদ্ধ শ্লোক আছে:
“বিদ্যা বিনয় সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।
শুণি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ।”
(৫.১৮)
অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তি সমস্ত জীবের মধ্যে সমানত্ব দেখতে পান—ব্রাহ্মণ, গরু, হাতি, কুকুর বা চণ্ডাল—সবাই সমান।
আমাদের সমাজের সব স্তরে এই শিক্ষা পৌঁছে দিতে হবে। নারীর অধিকার রক্ষা করা মানে মানবতাকে রক্ষা করা।
আপনার জীবনে সনাতন ধর্মের শিক্ষার প্রয়োগ
আপনার মনে কি কখনও প্রশ্ন জেগেছে, “আমি কীভাবে সনাতন ধর্মের এই শিক্ষাগুলো নিজের জীবনে প্রয়োগ করব?” প্রথমে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। নারী বা পুরুষ, আমরা সবাই একে অপরের পরিপূরক। নিজের পরিবারের নারীদের সম্মান দিয়ে শুরু করুন। সমাজে নারীর নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হন।
নতুন চিন্তার সূচনা
সনাতন ধর্ম আমাদের যে সমানতার শিক্ষা দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করলে সমাজে শান্তি ও সুখ ফিরে আসবে। আপনি কি মনে করেন, আজকের যুগে এই শাস্ত্রীয় শিক্ষাগুলোকে আমাদের নতুন করে রূপান্তরিত করা উচিত? আপনার উত্তর হয়তো সমাজের একটি ছোট পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।
“সমাজে সমানতার আলো ছড়িয়ে দিতে আপনি কি প্রস্তুত?”