ধর্মের নামে হওয়া সংঘাত সম্পর্কে সনাতন ধর্ম কী বলে?

আপনি কি কখনো ভেবেছেন, ধর্মের মূল উদ্দেশ্য শান্তি প্রতিষ্ঠা, কিন্তু তারপরও কেন ধর্মের নামে সংঘাত হয়? সনাতন ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি একটি গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সনাতন ধর্ম এমন একটি জীবনদর্শন যা কেবল আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং মানবজাতির কল্যাণ এবং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়। আজ আমি আপনাকে সনাতন ধর্মের আলোকে এই বিষয়টি সম্পর্কে একটি ধারণা দিতে চাই।

ধর্মের মূল উদ্দেশ্য

সনাতন ধর্ম বলে, ধর্মের উদ্দেশ্য কখনই বিভাজন সৃষ্টি করা নয়। বরং, এটি ব্যক্তিগত উন্নতি, সামাজিক শৃঙ্খলা এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার একটি পথ। “ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ”—এই মূল মন্ত্রটি আমাদের শেখায় যে ধর্ম রক্ষা করলে ধর্মও আমাদের রক্ষা করে। কিন্তু যখন ধর্মের প্রকৃত অর্থ ভুল বোঝা হয়, তখন সংঘাত সৃষ্টি হয়।

সংঘাতের শিকড়

সংঘাত সাধারণত তখনই হয় যখন মানুষ ধর্মকে সঠিকভাবে বোঝে না বা ভুলভাবে ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ:

  • ব্যক্তিগত স্বার্থে ধর্মের অপব্যবহার: অনেক সময় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ধর্মের নামে নিজের লাভের জন্য বিভেদ সৃষ্টি করে। এটি কেবল ধর্মের অপমান নয়, মানবতারও ক্ষতি।
  • অহংকার ও অপরের মতামত অবজ্ঞা: “আমার ধর্ম সেরা” এই ধারণা থেকেই সংঘাতের সূচনা হয়। অথচ ভগবদ্ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “সমদর্শি হি সর্বত্র”—সমস্ত জীবের প্রতি সমদৃষ্টি ধারণ করাই প্রকৃত ধর্ম।
  • অজ্ঞতা ও কুসংস্কার: ধর্মীয় গ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা ও অজ্ঞতার কারণে মানুষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। অথচ সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, “সত্যমেব জয়তে”—সত্যই জয়ী হয়।

সনাতন ধর্মের শিক্ষাগুলি

সনাতন ধর্ম সংঘাত সমাধানের জন্য আমাদের কিছু মৌলিক শিক্ষা দেয়, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করা হলো:

  • অহিংসা পরম ধর্ম
    মহাভারতে বলা হয়েছে, “অহিংসা পরমো ধর্মঃ”—অহিংসা সর্বোচ্চ ধর্ম। এটি কেবল শারীরিক নয়, মানসিক এবং মৌখিক স্তরেও প্রযোজ্য। আপনি যখন অন্যের মতামতকে সম্মান করেন, তখন সংঘাত কমে যায়।
  • সবার প্রতি সমদৃষ্টি
    উপনিষদে বলা হয়েছে, “বসুধৈব কুটুম্বকম”—সমস্ত বিশ্ব এক পরিবারের মতো। যখন আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি, তখন ধর্ম আমাদের বিভাজনের পরিবর্তে ঐক্যবদ্ধ করে।
  • ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতা
    সনাতন ধর্মে ধৈর্যকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণ হিসেবে ধরা হয়। রামায়ণে আমরা দেখি, ভগবান শ্রী রাম বহু অবিচারের পরেও ক্ষমা প্রদর্শন করেছিলেন। ক্ষমার গুণ সংঘাত নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • সত্যের অনুসন্ধান
    সনাতন ধর্ম অনুসারে, সত্য কখনো সংঘাত সৃষ্টি করে না। বরং এটি সংঘাত সমাধানে সাহায্য করে। যেমন, মহাত্মা গান্ধীর “সত্যাগ্রহ” আন্দোলন ধর্মীয় আদর্শ অনুসারেই পরিচালিত হয়েছিল।

উদাহরণ ও শিক্ষা

  • মহাভারতের শিক্ষা
    মহাভারতে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে সংঘাতের মূল কারণ ছিল অহংকার ও অসততা। কিন্তু এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্ গীতার মাধ্যমে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্”—কর্মে দক্ষতা এবং ন্যায়বোধই প্রকৃত ধর্ম।
  • অশোকের পরিবর্তন
    সম্রাট অশোক ধর্মের নামে যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু কলিঙ্গ যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তিনি অহিংসার পথে চলার প্রতিজ্ঞা করেন। তার জীবন আমাদের শেখায় যে ধর্ম কখনোই হিংসার সমর্থন করে না।
  • মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা আন্দোলন
    গান্ধীজী ধর্মকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করেছেন। তার নেতৃত্বে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছে অহিংস পন্থায়, যা সনাতন ধর্মের সত্যিকারের প্রতিফলন।
  • আদি শংকরাচার্যের উপদেশ
    শংকরাচার্য বলেছেন, “জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য”—এই দেহ, জাতি, ধর্ম সবই সাময়িক, কিন্তু ব্রহ্মন আমাদের মূল পরিচয়। এই জ্ঞান যদি সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সংঘাতের কোন স্থান থাকে না।

সংঘাত এড়ানোর উপায়

যদি আপনি সত্যিকারের সনাতন ধর্ম অনুসরণ করতে চান, তাহলে এই কাজগুলি করুন:

  • অন্যের ধর্ম ও মতামতকে শ্রদ্ধা করুন
  • ধর্মগ্রন্থ পড়ুন এবং সঠিকভাবে বুঝুন।
  • নিজের অহংকার ত্যাগ করুন এবং সকলের মঙ্গলের জন্য কাজ করুন।
  • যোগ এবং ধ্যানের মাধ্যমে নিজের চিন্তাভাবনা পরিষ্কার করুন।

শেষ কথা

আপনি যদি ধর্মকে বিভাজনের হাতিয়ার না বানিয়ে ঐক্যের সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেন, তবে সনাতন ধর্মের প্রকৃত মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারবেন। সনাতন ধর্মের শিক্ষাগুলি আজকের জগতে যতটা প্রাসঙ্গিক ছিল, ততটাই আজও প্রাসঙ্গিক। “আপনি কি ভেবেছেন, আমরা যদি সবাই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর আদর্শ গ্রহণ করি, তাহলে এই পৃথিবী কতটা শান্তিময় হতে পারে?”

এবার আপনার চিন্তার পালা। ধর্মকে জীবনের উন্নতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন, নাকি বিভাজনের? সিদ্ধান্ত আপনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top