দাম্পত্য জীবনে আত্মনিয়ন্ত্রণের ভূমিকা সনাতন ধর্মে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে?

সনাতন ধর্ম আমাদের জীবনযাত্রাকে একটি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার শিক্ষা দেয়। দাম্পত্য জীবনও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণের ভূমিকা অপরিসীম। আপনি যদি আপনার দাম্পত্য জীবনকে শান্তিপূর্ণ, সুখী ও স্থিতিশীল রাখতে চান, তাহলে সনাতন ধর্মের শিক্ষা আপনাকে সঠিক পথ দেখাতে পারে। এই ব্লগপোস্টে আমি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব, সনাতন ধর্মে দাম্পত্য জীবনে আত্মনিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

 আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি: সনাতন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি

সনাতন ধর্মে আত্মনিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হিসেবে বিবেচিত। “তপঃ স্বধর্মের একান্ত পথ, নিষ্কলঙ্কের বিচরণ”- এই কথাটি শ্রীমদ্ভাগবদ গীতার শিক্ষা থেকে আসে, যেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণ, বা ‘দম’ অর্থাৎ নিজের মন ও ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একজন সৎ ও আত্মনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি তার দাম্পত্য জীবনেও এই গুণগুলো প্রতিফলিত করেন। আপনার মন যদি সব সময় শান্ত থাকে, তাহলে আপনার সম্পর্কও সেই শান্তিতে আবদ্ধ থাকবে।

যদি আপনি ক্রোধ, লোভ বা অহংকারের দ্বারা আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাহলে আপনার দাম্পত্য জীবনও এসব নেতিবাচক অনুভূতির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়বে। তবে, যদি আপনি নিজের আত্মসংযমিত মনকে নিয়ন্ত্রণ করেন, আপনার দাম্পত্য জীবনও শান্তিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ হবে। এই কথা শ্রীমদ্ভাগবদ গীতার শ্লোক 6.5-এ বলা হয়েছে:

“উত্তম নিজেকে পরিশ্রমের মাধ্যমে পরিচালিত করে।”
এটি আমাদের শেখায় যে, আত্মনিয়ন্ত্রণ হলো প্রকৃত জীবন পরিচালনা। দাম্পত্য জীবনে আত্মনিয়ন্ত্রণের এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে, আপনি যখন আপনার স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে সহানুভূতির সাথে চলবেন, তখন সম্পর্কের মধ্যে আস্থা ও ভালোবাসা বাড়বে।

 দাম্পত্য জীবনে ধৈর্য্য এবং সহনশীলতা

দাম্পত্য জীবনে সব সময় মধুরতা থাকবে না। কিছু সময় তিক্ততা বা ভুল বোঝাবুঝি আসবেই। কিন্তু সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায় যে, সঠিক মনোভাবের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। “ধৈর্য্য হীন প্রাণী কখনও সুখী হতে পারে না”- এই বাণীটি হিন্দু শাস্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। তাই, একে অপরের প্রতি ধৈর্য্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন আত্মনিয়ন্ত্রিত হন, তখন আপনার ধৈর্য্য বেড়ে যায়, এবং আপনি আরও সহিষ্ণু হন।

ধরুন, আপনার সঙ্গী কোনো ভুল করেছেন। সাধারণত আমরা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তা উগড়ে দিই। কিন্তু সনাতন ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী, আপনাকে উচিত সেই পরিস্থিতি শান্তভাবে মোকাবেলা করা। এতে আপনার সঙ্গীও বুঝতে পারবে, আপনি আত্মনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি এবং সম্পর্ককে উন্নত করার দিকে এগিয়ে যাবেন। যেমন শ্রীমদ্ভাগবদ গীতার 15.9 শ্লোকটি বলে:

“যে ব্যক্তি সত্য, কল্যাণ ও শান্তির দিকে চলতে চায়, সে দেহের প্রতি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে।”

এটি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, আপনার দাম্পত্য সম্পর্কেও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আপনাকে নিজের অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

 কাম ও লোভের প্রতি নিয়ন্ত্রণ

একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা সনাতন ধর্ম দাম্পত্য জীবনে আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য শেখায়, তা হল কাম ও লোভের প্রতি নিয়ন্ত্রণ। দাম্পত্য সম্পর্ক একটি সন্ন্যাসী জীবন নয়, তবে এটি এমন একটি সম্পর্ক যেখানে প্রেম, সহানুভূতি ও সততা থাকতে হবে। সুতরাং, যখন দুইজন ব্যক্তি একে অপরকে ভালোবাসে, তখন তাদের ইন্দ্রিয়গুলোও একে অপরের প্রতি নিবেদিত হওয়া উচিত।

কিন্তু আমাদের সমাজে প্রায়ই কাম এবং লোভের মাধ্যমে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। শ্রীমদ্ভাগবদ গীতার 3.39 শ্লোক অনুযায়ী:

“মনুষ্যবদ্ধ মনের আসক্তি কামনা-বাসনা দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই কামনা-বাসনা হলো শত্রু, যা সত্য ও শুভকে অন্ধকারে ঢেকে দেয়।”

এই শ্লোকটি সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের জানায় যে, কাম এবং লোভ মানুষের আত্মার সবচেয়ে বড় শত্রু। আপনি যদি এসবের নিয়ন্ত্রণে থাকেন, তাহলে আপনার দাম্পত্য জীবন সঠিক পথে পরিচালিত হবে। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা এবং পরস্পরের ইচ্ছার প্রতি সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা প্রয়োজন।

 সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসার শক্তি

সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা হলো ‘প্রেম’। প্রেমই হলো আত্মনিয়ন্ত্রণের মূল ভিত্তি। যখন আপনি আপনার সঙ্গীকে সম্মান ও ভালোবাসার সঙ্গে দেখেন, তখন আত্মনিয়ন্ত্রণ আপনার কাছে সহজ হয়ে ওঠে। প্রেমের এই শক্তি দাম্পত্য জীবনে সব কিছু সুন্দর করে তোলে। শ্রীমদ্ভাগবদ গীতার 10.20 শ্লোকটি বলে:

“আমি প্রেমের মধ্যে সর্বত্র বিরাজ করি, প্রেমই আমার সত্য, প্রেমই আমার শক্তি।”

এটি জানিয়ে দেয় যে, প্রেমই হলো জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী গুণ। আপনি যদি প্রেমের মধ্যে চলেন, আপনার মনও নিয়ন্ত্রণে থাকে, এবং দাম্পত্য জীবনও সফল হয়।

 দাম্পত্য জীবনে কর্তব্য পালন

সনাতন ধর্মে প্রতিটি ব্যক্তির কিছু কর্তব্য বা ‘ধর্ম’ থাকে। দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রেও এই কর্তব্য পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন আপনি আপনার সঙ্গীকে দয়ার সঙ্গে সম্মান করবেন, তখন এই সম্পর্ক স্থায়ী ও সুখী হবে। শ্রীমদ্ভাগবদ গীতার 3.35 শ্লোকটি বলেছে:

“কর্তব্য পালন করাই প্রকৃত সুখের উৎস, কারণ এটি আত্মার উন্নতির পথে সহায়ক।”

এই শ্লোকটি আমাদের শেখায়, আমাদের কর্তব্য পালন আমাদের সুখী জীবনের অংশ হতে পারে। দাম্পত্য জীবনেও একে অপরের কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করা হয়, তখন আত্মনিয়ন্ত্রণও সহজ হয়।

উপসংহার

আত্মনিয়ন্ত্রণ দাম্পত্য জীবনের একটি অপরিহার্য গুণ, যা সনাতন ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী, সম্পর্কের স্থায়িত্ব, শান্তি ও সুখের জন্য প্রয়োজনীয়। আপনি যখন নিজের মনকে শান্ত ও নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, তখন আপনার দাম্পত্য জীবনও সুখী ও সার্থক হবে। আজকের দিনে, এই শিক্ষা আমরা কীভাবে বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারি? আপনার দাম্পত্য জীবনে শান্তি আনতে আত্মনিয়ন্ত্রণের এই মহা শক্তিকে গ্রহণ করে দেখুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top