সনাতন ধর্মের প্রাচীন জ্ঞান ও দর্শন আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পথ দেখায়। জাতপাত ও রাজনৈতিক বিভাজনের মতো সামাজিক সমস্যা সমাধানে সনাতন ধর্মের অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমি মনে করি, আপনি যদি সনাতন ধর্মের গভীরতায় প্রবেশ করেন, তবে এই বিভাজনের প্রকৃত কারণ ও সমাধান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাবেন।
সনাতন ধর্মে জাতপাতের মূল ধারণা
সনাতন ধর্মের শাস্ত্রগুলোতে “বর্ণব্যবস্থা” নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা কার্যক্রমভিত্তিক। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
“চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।”
অর্থাৎ, চার বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে গুণ ও কর্ম অনুযায়ী, জন্ম বা পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শিক্ষা দেয় যে একজন ব্যক্তির যোগ্যতা, কর্ম এবং চরিত্র তার প্রকৃত পরিচয় বহন করে, জাত বা জন্ম নয়।
কিন্তু আমাদের সমাজে বিভিন্ন সময়ে এই বর্ণব্যবস্থা ভ্রান্ত অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে এবং জন্মভিত্তিক জাতপাতের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে মানুষে মানুষে বিভেদ বেড়েছে, যা রাজনৈতিক বিভাজনের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছে।
রাজনৈতিক বিভাজনের শেকড়
রাজনীতি যখন ক্ষমতার খেলায় পরিণত হয়, তখন জাতপাতের মতো সামাজিক বিভাজন একটি হাতিয়ার হয়ে ওঠে। আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, জাতপাতকে ব্যবহার করে শাসকরা সমাজকে বিভক্ত করেছে। এই বিভাজন আমাদের ঐক্য ও শক্তিকে দুর্বল করে।
কিন্তু সনাতন ধর্ম আমাদের শেখায়, ঐক্যের শক্তি অপরিসীম। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে,
“সম গচ্ছধ্বং সম বদ্ধ্বং”
অর্থাৎ, আমরা সবাই একসাথে চলব, একসাথে কাজ করব। এই ঐক্যের বার্তা গ্রহণ করলে আমরা রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারি।
বাস্তব উদাহরণ
- গুরু রবিদাসের শিক্ষা: জন্মের ভিত্তিতে জাতপাতের ধারণাকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, “মানুষের প্রকৃত ধর্ম তার কর্ম এবং আচার-ব্যবহার।”
- গান্ধীজির আন্দোলন: মহাত্মা গান্ধী জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। “অস্পৃশ্যতা” দূরীকরণে তার প্রচেষ্টা সনাতন ধর্মের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন।
- বসুদৈব কুটুম্বকমের ধারণা: সনাতন ধর্মে পৃথিবীর সবাইকে এক পরিবারের অংশ হিসেবে দেখা হয়। “বসুধৈব কুটুম্বকম” মানসিকতা জাতপাত ও বিভাজন মুছে দিতে সাহায্য করে।
সনাতন ধর্মের অনুশীলন কীভাবে বিভাজন দূর করতে পারে
আমি মনে করি, আপনি যদি সনাতন ধর্মের মূল বার্তাগুলোকে জীবনে ধারণ করেন, তাহলে জাতপাত ও বিভাজনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবেন। এখানে কয়েকটি মূল শিক্ষা:
- অহিংসা এবং সমতা: সনাতন ধর্ম অহিংসা ও সমতার ওপর জোর দেয়।
- কর্মফল তত্ত্ব: গীতার শিক্ষা অনুযায়ী, কর্মই মানুষকে মহান করে তোলে, জাত নয়।
- যোগ এবং ধ্যানের অনুশীলন: যোগ এবং ধ্যান আপনাকে ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্তি দেয় এবং সহমর্মিতা বৃদ্ধি করে।
শেষ কথা
যদি আমরা সনাতন ধর্মের বার্তা গ্রহণ করি এবং তা জীবনে কার্যকর করি, তাহলে জাতপাতের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিভাজন দূর করা সম্ভব। একবার নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন—আপনি কি আপনার গুণ এবং কর্ম দিয়ে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান, নাকি বিভাজনের চক্রে আটকে থাকতে চান?
“ধর্ম রক্ষতি রক্ষিতঃ” – ধর্মকে রক্ষা করলে, ধর্ম আপনাকেও রক্ষা করবে।”
এই চেতনা নিয়ে এগিয়ে চলুন, সনাতন ধর্মের আলোয় বিভেদের অন্ধকার দূর করুন।