কৃষি এবং এর প্রতি সনাতন ধর্মের মনোভাব কী?

সনাতন ধর্মের মূল স্তম্ভ হলো প্রকৃতির প্রতি সম্মান এবং সৃষ্টির প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ। কৃষি, যাকে আমরা আধুনিক ভাষায় কৃষিকাজ বলি, সনাতন ধর্মের দৃষ্টিতে কেবলমাত্র একটি জীবিকা নয়, এটি এক ধরণের পূণ্যকর্ম। আমি যখন সনাতন ধর্মের গভীরে যাই, তখন বুঝি যে কৃষির মধ্যে আমাদের জীবনের সবকিছু গাঁথা রয়েছে—পৃথিবী, প্রকৃতি, এবং ঈশ্বর। এই বিষয়ে আপনার যদি কোনো সন্দেহ থাকে, তবে আসুন আমরা একসঙ্গে সনাতন ধর্মের গ্রন্থ এবং উদাহরণগুলো বিশ্লেষণ করি।

কৃষি এবং ঋগ্বেদের দৃষ্টিভঙ্গি

ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, “অন্নম বহু কুর্যাৎ” অর্থাৎ প্রচুর অন্ন উৎপাদন করো। এই উক্তি কৃষির গুরুত্ব বোঝায়। আমরা যদি নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুখী ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন চাই, তাহলে আমাদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত মাটি চাষ করা এবং প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য স্থাপন করা। ঋগ্বেদের এই বার্তা শুধু শস্য উৎপাদন নয়, বরং কৃষির প্রতি এক গভীর আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।

কৃষি এবং ধর্মীয় আচরণ

আপনার কি মনে হয় যে কৃষি শুধু একটি প্রথাগত কাজ? তা কিন্তু নয়। সনাতন ধর্মে কৃষিকাজকে একটি ধর্মীয় আচার হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যেমন, গোহত্যা নিষিদ্ধ এবং গরুকে মাতারূপে পূজা করার পেছনে একটি কারণ হলো, গরু কৃষিকাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গরু আমাদের শুধু দুধ দেয় না, এটি চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সারও সরবরাহ করে। গরুর এই ভূমিকা গীতার শ্লোকে প্রতিফলিত হয়েছে:

“কৃষিগোরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্” (ভগবদ্গীতা ১৮.৪৪)।

অর্থাৎ কৃষি, গো-রক্ষা এবং বাণিজ্য—এগুলো বৈশ্যদের (একটি সামাজিক স্তর) স্বাভাবিক কর্ম। এই শ্লোক থেকে বোঝা যায় যে কৃষিকে সনাতন ধর্মে কেবল পেশা নয়, বরং ধর্মের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে।

রামায়ণ ও কৃষি

রামায়ণে কৃষির উদাহরণ বারবার উঠে এসেছে। আমরা যদি ভাবি, শ্রী রাম যখন অযোধ্যার রাজা ছিলেন, তখন তিনি জনগণের কৃষিকাজের উপর কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। রামরাজ্যে ফসলের অভাব ছিল না, কারণ মাটি ছিল উর্বর এবং মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সঠিক ভারসাম্য বজায় রেখেছিল। এমনকি, লক্ষ্মণের মুখেও আমরা শোনি যে কৃষি ও প্রকৃতি রক্ষা করা রাজধর্মের অন্তর্ভুক্ত।

কৃষি এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবন

আপনার এবং আমার দৈনন্দিন জীবনে কৃষির প্রভাব কী? আপনি কি জানেন, আমরা যে খাবার খাই, তা সরাসরি কৃষির ফল? তাই কৃষকের পরিশ্রম এবং প্রকৃতির দানকে সম্মান করা আমাদের কর্তব্য। সনাতন ধর্মে কৃষককে দেবতার সমতুল্য মনে করা হয়েছে, কারণ তিনি আমাদের অন্নের যোগান দেন।

“কৃষকো ভবতি লক্ষ্মীঃ”—অর্থাৎ কৃষকই প্রকৃত লক্ষ্মীর রূপ। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শিখিয়ে দেয় যে আপনি যখন খাদ্য গ্রহণ করেন, তখন সেই খাদ্যের প্রতি এবং তার উৎপাদকদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

গঙ্গার জল এবং কৃষি

গঙ্গা নদী শুধু পবিত্রই নয়, কৃষির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে ভাবি, তখন বুঝি এই নদী আমাদের কত কিছু দিয়েছে। মহাভারতে গঙ্গাকে “জীবনের দাতা” বলা হয়েছে, কারণ এর জল কৃষিক্ষেত্রে প্রাণ সঞ্চার করে। আপনি কি জানেন, সনাতন ধর্মে গঙ্গার জল দিয়ে চাষাবাদ করাকে পূণ্যস্বরূপ গণ্য করা হয়েছে? গঙ্গার এই ভূমিকা আমাদের কৃষির গুরুত্ব এবং প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

পরিবেশ রক্ষা এবং কৃষি

সনাতন ধর্ম পরিবেশ রক্ষার কথা বলে এবং কৃষিকে পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় করে দেখায়। আপনি যদি কৃষির মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করতে চান, তাহলে প্রাকৃতিক চাষাবাদে ফিরে যান। বেদে বলা হয়েছে:

“মাতা ভূমিঃ পুত্রোহম্ পৃথিব্যাঃ” (অর্থাৎ, পৃথিবী আমার মা এবং আমি পৃথিবীর পুত্র)।

এটি একটি প্রতিশ্রুতি, যেখানে আমরা আমাদের মাটিকে পবিত্র এবং সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। প্রাকৃতিক চাষাবাদে কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহৃত হয় না, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

কৃষি থেকে শিক্ষা

আপনার কি মনে হয় কৃষি শুধুই শারীরিক পরিশ্রমের কাজ? আমি বলব, কৃষি আমাদের জীবনের গভীর শিক্ষাও দেয়। বীজ বপন থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত যে ধৈর্য এবং অধ্যবসায় দরকার, তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজন। কৃষক যেমন মাটির প্রতি যত্নশীল, আমাদেরও তেমনই আমাদের চারপাশের মানুষের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত।

শেষ ভাবনা

আপনি যদি সনাতন ধর্মের মূল ভাবনার সঙ্গে জীবনযাপন করতে চান, তাহলে কৃষিকে আপনার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে তুলুন। শুধু খাদ্য উৎপাদন নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করুন। আজকের দিনে যখন পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা আমরা শুনি, তখন সনাতন ধর্মের এই শিক্ষাগুলো আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আপনি কি কখনও ভেবেছেন, আপনি নিজে কীভাবে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারবেন? সনাতন ধর্মের প্রতি যদি আপনার বিশ্বাস থাকে, তবে আজ থেকেই মাটিকে ভালোবাসুন এবং চাষাবাদে মনোনিবেশ করুন।

আপনার চিন্তাভাবনার জন্য আমি একটি প্রশ্ন রেখে যাচ্ছি—“আপনি কি সনাতন ধর্মের শিক্ষাকে অনুসরণ করে কৃষি ও প্রকৃতির প্রতি আপনার দায়িত্ব পালন করছেন?”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top